সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অন্যান্য সরকার ব্যবস্থা থেকে উত্তম কেন? আলােচনা কর


প্রশ্নঃ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অন্যান্য সরকার ব্যবস্থা থেকে উত্তম কেন? আলােচনা কর।
অথবা, সংসদীয় সরকার কেন শ্রেষ্ঠ সরকার? আলােচনা কর।
অথবা, সংসদীয় সরকার অন্যান্য সরকার ব্যবস্থার চেয়ে উত্তম।- ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ সরকারের শ্রেণিকরণ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগের সম্পর্কের ভিত্তিতে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার বা সংসদীয় সরকার এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার এ দু'ভাগে বিভক্ত করা হয়। এ দু'শ্রেণির মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার বা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বিশ্বের প্রায় অনেক দেশে প্রচলিত রয়েছে। এ সম্পর্কে অধ্যাপক অ্যাপলবি বলেছেন, "Parliamentary government is decidedly batter after any other government." অর্থাৎ এ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অন্যান্য সরকার ব্যবস্থা থেকে সবচেয়ে উত্তম সরকার ব্যবস্থা।

সংসদীয় সরকার অন্যান্য সরকার থেকে উত্তম কেনঃ যেসব উপাদান বা গুণাবলির জন্য সংসদীয় সরকার শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সেগুলাে নিম্নে আলােচনা করা হলাে-

১. দায়িত্বশীলতাঃ সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে তাদের যাবতীয় কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকেন। আইনসভা বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থা হারালে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করতে হয়।

২. আইন ও শাসন বিভাগের সম্পর্কঃ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। এরূপ শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতিকে স্বীকার করা হয় না বলে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের পথ প্রশস্ত হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বেজহট মন্তব্য করেন যে, "Cabinet is a hyphen that joins, a buckle that fasters, the executive and legislative departments together."

৩. জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থাঃ জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার উপস্থিতি মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের বিশেষ গুণ। এখানে প্রত্যেক মন্ত্রীকেই নিজ নিজ কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। জবাবদিহিতার কারণে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা সুশাসনে পরিণত হয়।

৪. সরকারের স্থায়িত্বঃ সরকারের স্থায়িত্ব সংসদীয় শাসনব্যবস্থার একটি অন্যতম গুণ। সাধারণত আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে বলে এরূপ সরকার সহজেই আইনসভার সক্রিয় সমর্থন ও সহানুভূতি লাভ করে। স্থায়িত্বের ব্যাপারে এরূপ সরকারকে চিন্তা করতে হয় না। ফলে সরকার জনকল্যাণ সাধনে পরিপূর্ণ আত্মনিয়ােগ করতে পারে।

৫. গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় থাকেঃ এরূপ শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভাই হলাে প্রকৃত শাসক। এ মন্ত্রিসভা আবার জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়। ফলে জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারাই সরকারি নীতি নির্ধারিত হয় এবং শাসনকার্য পরিচালিত হয়। তাই গণতান্ত্রিক শাসন বজায় থাকে।

৬. নমনীয় ও পরিবর্তনশীলঃ সংসদীয় শাসনব্যবস্থার কাঠামাের সাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সংগতি রক্ষা করে প্রয়ােজন মাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

৭. বিরােধী দলের সাথে সম্পর্কঃ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বিরােধী দলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করলেও সংখ্যালঘিষ্ঠ বিরােধী দল আইনসভায় সরকারের সমালােচনা ও বিরােধিতা করে। এছাড়াও বিরােধী দল দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলাে প্রতিকারের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এভাবে সংসদে সরকারি ও বিরােধী দল পরস্পর আলােচনার ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে।

৮. জনগণের সার্বভৌমত্বঃ মন্ত্রিসভা চালিত সরকার জনমতের সরকার। জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার চূড়ান্ত মালিক। এ সম্পর্কে অধ্যাপক জেনিংস বলেছেন, “সংসদীয় সরকার বলতে জনমতের দ্বারা গঠিত সরকারকেই বুঝায়।”

৯. যােগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিকে নিযুক্তঃ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় যােগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিকে নিয়মতান্ত্রিক শাসকের পদ প্রদান করে তার যােগ্যতাকে মর্যাদা দেওয়া হয়। ফলে সুযােগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা দেশের নেতৃত্ব দানের সুযােগ পান। অধ্যাপক লাস্কির মতে, “রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মন্ত্রিগণের চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের মন্ত্রিবর্গ অধিক যােগ্যতাসম্পন্ন হয়। কারণ তারা দীর্ঘকাল রাজনীতির সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত থাকার পর উক্ত পদে সমাসীন হন।”

১০. সময়ের সাথে সামঞ্জস্য বিধানঃ মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় সময়ের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব হয়। কেননা কোন মন্ত্রিপরিষদ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কার্যভার গ্রহণ করলেও যে কোন সময় এ স্থলে অন্য কোন মন্ত্রিপরিষদকে স্থলাভিষিক্ত করা যায়।

১১. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাঃ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সঠিক গণতান্ত্রিক হওয়ায় জনগণ সরকারি কার্যক্রমে অধিক অংশগ্রহণের সুযােগ পায়। এতে সরকার ও জনগণ উভয়েরই কল্যাণ সাধিত হয়।

১২. নির্বাচকমণ্ডলীর আশা-আকাঙক্ষাঃ এ ব্যবস্থায় নির্বাচকমণ্ডলীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। যদি না ঘটে তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে আইনসভা ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যায়।

১৩. রাজনৈতিক চেতনা লাভঃ মন্ত্রিপরিষদ সরকারে আইন পরিষদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইন পরিষদে যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় এবং যেভাবে জনমতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তা জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে।

১৪. রাজনৈতিক মেরুকরণঃ এই ব্যবস্থায় নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ দল বিরােধী দলের ভূমিকা পালন করে। এতে অনেক সময় ছােট ছােট দল এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থী বা আইনসভার সদস্যরা বড় দলগুলাের সাথে একত্রিত হয়। ফলে বহু দলের হানাহানি থেকে অল্পসংখ্যক বৃহৎ দলের উদ্ভব ঘটার সুফল দেখা দেয়।

১৫. দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্য উপযােগীঃ যে দেশে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান সে দেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিশেষ উপযােগী। এই ব্যবস্থায় দুটি প্রধান দলের কার্যকারিতার সুফল পাওয়া যায়।

১৬. সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বঃ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইনসভায় জনগণের সকল শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। এটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও দলগুলােকে নিরাপত্তা দান করে। কেননা কোন এলাকা হতে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক জনভােট লাভ করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলও আইনসভাতে প্রতিনিধিত্ব লাভ করে।

উপসংহারঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি, উপরের আলােচনা থেকে সহজেই বুঝা যায় সংসদীয় সরকার কেন অন্যান্য সরকার ব্যবস্থা হতে শ্রেষ্ঠ। কারণ অন্য কোন সরকার ব্যবস্থায় এসব গুণাবলী লক্ষ্য করা যায় না। অর্থাৎ সংসদীয় সরকার পদ্ধতির এমন কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অন্য কোন সরকার পদ্ধতিতে লক্ষ্য করা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক