উপস্থাপনাঃ ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বণিকরা রাজকীয় অনুমতি পেয়ে প্রথম ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। সাধারণ একটি বণিক সমিতি হিসেবে উপমহাদেশে প্রবেশ করলেও পরবর্তী মুঘল ও অন্যান্য আঞ্চলিক শাসকদের দুর্বলতা, অযােগ্যতা, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও বেনিয়া হিন্দুদের লােভ তাদের বাণিজ্যের পরিমণ্ডল থেকে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সুযােগ সৃষ্টি করে দেয়।
ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাসঃ
১. বণিক ছদ্মবেশে ইংরেজদের আগমনঃ ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ২১৭ জন ইংরেজ বণিককে নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানি ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে পনেরাে বছর বাণিজ্য করার সনদ নিয়ে ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। তারা মুঘল সম্রাটদের দয়া লাভের আপ্রাণ চেষ্টা করে সফল হয় এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে বণিক ছদ্মবেশে ব্যবসায় শুরু করে।
২. সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমানঃ ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি স্থাপনের লক্ষ্যে ক্যাপ্টেন হকিন্স ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের একটি সুপারিশপত্র নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাৎ করে বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেন, কিন্তু স্থানীয় বণিক সম্প্রদায় ও পর্তুগীজদের বিরােধিতার মুখে হকিন্সের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ক্যাপ্টেন বেস্টের নেতৃত্বে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুটি জাহাজ পর্তুগীজ নৌবহর বিধ্বস্ত করে সুরাট বন্দরে অবস্থান গ্রহণ করে। ক্যাপ্টেন বেল্টের সাফল্যে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে এক ফরমান জারি করে ইংরেজদের গুজরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন।
৩. রাজা জেমস কর্তৃক প্রেরণঃ ক্যাপ্টেন হকিন্সের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা প্রথম জেমস স্যার টমাস রােকে দূত হিসেবে জাহাঙ্গীরের দরবারে প্রেরণ করেন। তিনি বাণিজ্য সংক্রান্ত বহুবিধ সুবিধা আদায়ের সাথে। সাথে আহমদাবাদ, আগ্রা ও ব্রোটে বাণিজ্য করার অনুমতি লাভ করেন। পরবর্ততে তারা মাদ্রাজ, মুম্বে, কলকাতা প্রভৃতি অঞ্চলে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে একচেটিয়া বাণিজ্য করার সুযােগ লাভ করে।
৪. বাংলাদেশে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপনঃ ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে বাংলাদেশ থেকে পর্তুগীজদের তাড়িয়ে তদস্থলে ইংরেজ বণিকরা বাংলা ও বিহারে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি লাভ করে। পরে তারা হুগলী, পাটনা, কাসিম বাজার, ঢাকা, রাজমহল, মালদহ প্রভৃতি স্থানে তাদের কুঠি স্থাপন করে।
৫. মাদ্রাজ শহরের গােড়া পত্তনঃ ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সিস ডে নামক জনৈক ইংরেজ চন্দ্রগিরি নামক ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজার নিকট থেকে করমণ্ডল উপকূলে কিছু জমি নিয়ে মাদ্রাজ শহরের গােড়া পত্তন করেন। এমনকি এখানে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র ও সেন্ট জর্জ দুর্গ স্থাপন করা হয়।
৬. ইংরেজদের মুম্বে শহর লাভঃ ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডরাজ দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগালের রাজকন্যা ক্যাথরিন ব্রাগাঞ্জাকে বিয়ে করলে উপমহাদেশে পর্তুগীজ অধিকৃত স্থান মুম্বে শহরটি তাকে যৌতুক হিসেবে দেয়া হয়। পরবর্তীতে রাজা চার্লস তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ইজারা দেন।
৭. বাংলাদেশে অবাধ বাণিজ্যিক সুবিধালাভঃ ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা শাহ শুজা এক আদেশে ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার প্রদান করে, কিন্তু পরবর্তীতে ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার বাতিল করে শুল্ক পদ্ধতি চালু করেন। আবার ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব এ সুবিধা রহিত করে অন্যান্য বণিকের মতাে তাদের পণ্যদ্রব্যের ২% এবং জিযিয়া কর হিসেবে ১.৫% দেয়ার শর্তে ইংরেজদের মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বত্র ব্যবসায় করার অনুমতি দেন।
৮. মুঘলদের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সংঘর্ষঃ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ বণিকরা তাদের মুখােচ্ছবি প্রদর্শনে তৎপর হয়। কারণ ইংরেজ বণিকরা শান্তির নীতি পরিত্যাগ করে যুদ্ধনীতি গ্রহণ করে। তারা দেশীয় রাজন্যবর্গের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের অনুমতি লাভ করে। ফলে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন এলাকায় কোম্পানির লােকজন ও স্থানীয় শাসকদের সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ বাধে। এক পর্যায়ে স্যার জন চাইল্ড মুম্বে বন্দর অবরােধ করে মুঘল নৌবহরের ওপর আক্রমণ করে। ইংরেজদের ঔদ্ধত্যমূলক আচরণ এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মুম্বে আক্রমণের নির্দেশ দেন। জন চাইল্ড পরাজিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কোম্পানি ক্ষতিপূরণস্বরূপ নগদ দেড় লক্ষ টাকা এবং তাদের অধিকৃত অঞ্চলগুলাে সম্রাটকে ফেরত দিয়ে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
৯. কলকাতা নগরী প্রতিষ্ঠাঃ ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে জন চার্নক বাংলাদেশের ভাগীরথী নদীর তীরে কালিকট, সুতানটি ও গােবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম ক্রয় করে কলকাতা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।
১০. পুনরায় বাংলায় কুঠি স্থাপনঃ ইংরেজরা বাংলাদেশে বাণিজ্য করার জন্য মুঘলদের অনুমতি লাভ করে বাংলাদেশের হুগলী, কাসিম বাজার, ঢাকা, রাজমহল, মালদহ প্রভৃতি স্থানে কুঠি স্থাপন করেন। ১৬৯১ থেকে ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইংরেজ বণিকরা বাংলাদেশে তাদের বাণিজ্য কুঠিগুলাে সুরক্ষিত করে ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অবশেষে ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে।
১১. সম্রাট ফররুখ সিয়ারের ফরমানঃ ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ দূত জন স্যারম্যান বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট ফররুখ সিয়ারের দরবারে হাজির হন। তার সাথে প্রখ্যাত ইংরেজ চিকিৎসক হ্যামিলটনও ছিলেন। তিনি সম্রাটের কঠিন রােগের চিকিৎসা করেন। এতে সম্রাট খুশি হয়ে কোম্পানির লােকজনকে বাংলা, বিহার, মাদ্রাজ ও মুম্বেতে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার সনদ প্রদান করেন। এ ফরমান বলেই ইংরেজ বণিকরা নিজস্ব মুদ্রা ও কলকাতার চারপাশে জমি ক্রয় করার অধিকার পায়। এভাবেই তারা কালক্রমে শক্তি অর্জন করে বাংলার নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
১২. ইংরেজ ও ফরাসি বণিকদের দ্বন্দ্বঃ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের পর ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করতে ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই ফরাসি কোম্পানি পর্যায়ক্রমে সুরাট, মসলিপট্টম, পণ্ডিচেরী, চন্দননগর, মাহে, কালিকট প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে। তখন আধিপত্য বিস্তার এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। শক্তি পরীক্ষায় পরাভূত হয়ে ফরাসিরা ভারত ত্যাগ করলে এখানে ইংরেজদের একক আধিপত্য বিস্তারের পথ সুগম হয়।
১৩. সাম্রাজ্য স্থাপনের সক্রিয় প্রচেষ্টাঃ চতুর ইংরেজরা হিন্দুদের ষড়যন্ত্রমূলক সহায়তার মাধ্যমে ১৭৫৭ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পলাশীর যুদ্ধে এবং ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমকে পরাভূত করে ভারতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ভিত রচনা করে।
১৪. বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভঃ ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে, যা বাংলাদেশে এবং পরবর্তীকালে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ আধিপত্য স্থাপনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ইংরেজরাই বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসনে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতে প্রাধান্য বিস্তার করে।
উপসংহারঃ ভারত উপমহাদেশের শাসকদের উদারতা ও দুর্বলতার সুযােগে এবং ধন সম্পদের লােভে ইংরেজ বণিকরা বাণিজ্য করতে এসে শেষ পর্যন্ত এদেশ দখলের মাধ্যমে নিজেদের প্রভুত্ব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ফলে শুরু হয় ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।
0 মন্তব্যসমূহ