সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার যুদ্ধের বিবরণ দাও


প্রশ্নঃ সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে কেন উত্তরাধিকার যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল?
অথবা, সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার যুদ্ধের একটি বিবরণ দাও।

উপস্থাপনাঃ উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব মুঘল ইতিহাসে একটি নিয়মিত, নিরন্তর ও প্রথাগত প্রক্রিয়া। এজন্য ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সম্রাট শাহজাহানের শাসনকালকে মুঘল শাসনের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হলেও তার ছেলেদের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব সমগ্র মুসলিম ভারতের ইতিহাসে একটি কলংকময় অধ্যায় সংযােজন করেছে। সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতির অভাবে পিতা পুত্রের বিরুদ্ধে, পুত্র পিতার বিরুদ্ধে এবং ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

উত্তরাধিকার যুদ্ধের কারণসমূহঃ
১. শাহজাহানের অসুস্থতাঃ ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট শাহজাহান অস হয়ে পড়লে তার আরােগ্য লাভের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ তিরােহিত হয়ে পড়ে। এমন কি এরকম গুজব রটে যে, শাহজাহানের মৃত্যু হয়েছে। তখন ক্ষমতালিপ্সু তার চার পুত্র দারাশিকো, মুরাদ, শুজা ও আওরঙ্গজেব-এর মধ্যে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে গৃহযুদ্ধ দানা বেঁধে ওঠে।

২. সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাবঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “মুঘল সম্রাটদের কোনাে সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতি না থাকায় জোর যার মুল্লুক তার’-এ নীতির প্রাধান্যের কারণে শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।”

৩. পুত্রদের চারিত্রিক বৈচিত্র্যঃ সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্রের চারিত্রিক পার্থক্যই ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। উদারপন্থী, রুক্ষ মেজাজ ও অদক্ষ সেনানায়ক দারা দূরদর্শী রণকুশলী আওরঙ্গজেবের সমকক্ষ ছিলেন না। আওরঙ্গজেবের উন্নত রণকৌশল ও চারিত্রিক দৃঢ়তার নিকট অযােগ্য, মদ্যপায়ী, চরিত্রহীন শুজা ও মুরাদকে বিপর্যস্ত হতে হয়।

৪. যােগ্যতার পার্থক্যঃ ব্যক্তিগত ও চারিত্রিক গুণাবলির দিক থেকে চার পুত্রের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য থাকায় তাদের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।

৫. শাহজাহানের অন্ধ স্নেহঃ ঐতিহাসিক ভি. ডি. স্মিথ বলেন, “সম্রাটের পুত্রদের মধ্যে আওরঙ্গজেব ছিলেন সর্বাপেক্ষা যােগ্য ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। অথচ জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার প্রতি ছিল সম্রাটের অন্ধ স্নেহ। এ অন্ধ স্নেহ উত্তরাধিকার যুদ্ধ ত্বরান্বিত করে।”

৬. শাহজাহানের দুর্ব্যবহারঃ যােগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের সুবেদারী থেকে অব্যাহতি প্রদানপূর্বক বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা অভিযান নিষিদ্ধ করেন। সুলতানের শাসন বিষয়ে রাজকোষ থেকে খরচদানে অস্বীকৃতি, আওরঙ্গজেবের পুত্রের সাথে শুজার মেয়ের বিবাহ বাতিল, সর্বোপরি আওরঙ্গজেবের প্রতি এরূপ দুর্ব্যবহার ভ্রাতৃবিরােধ প্রকট করে তােলে।

৭. উসকানিমূলক গােপন পত্র প্রেরণঃ জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার কুপরামর্শে সম্রাট পুত্রদের পরস্পরের প্রতি উসকানিমূলক পত্র প্রেরণ করে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব পরিস্থিতি আরাে জটিল করে তােলেন।

৮. ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অসন্তোষঃ দারার হিন্দু ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ আর ইসলামের প্রতি উদাসীনতা ধার্মিক মুসলমানদের মনে দারুণভাবে আঘাত হানে। মুসলমানদের এ অসন্তোষও বিরােধের ভাব সৃষ্টি করে।

৯. আওরঙ্গজেবের জনপ্রিয়তাঃ দারার তুলনায় আওরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও সর্বগুণে গুণান্বিত। ফলে তিনি তার চরিত্রের জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিকট অত্যন্ত গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠেন। এটাও ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের অন্যতম একটি কারণ।

১০. শুজা ও মুরাদের ভােগ বিলাসিতাঃ শাহজাহানের অপর দু’পুত্র শুজা ও মুরাদ সুদক্ষ, প্রাজ্ঞ এবং রুচিবান শাসক হওয়া সত্ত্বেও ভােগবিলাসে মত্ত হয়ে অকর্মণ্য হয়ে ওঠেন। এতে তারা জনসমর্থন হারিয়ে আওরঙ্গজেবের বলিষ্ঠ চরিত্রের কাছে পরাজিত হন।

১১. দারার দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপঃ সম্রাটের অসুস্থতার সুযােগে দারার রাজকার্যে যােগদান, প্রদেশের সাথে যােগাযােগ বন্ধ করে দেয়া প্রভৃতি দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপ ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব ত্বরান্বিত করে তােলে।

১২. দু'কন্যার পক্ষপাতিত্বঃ শাহজাহানের দুবিদূষী কন্যাও দু'পক্ষ অবলম্বন করেন। ফলে পিতা ও পুত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।

১৩. আওরঙ্গজেবের দূতকে বন্দিঃ দারা রাজকার্যে যোগদান করে রাজধানীর সাথে বাইরের যোগাযােগ বন্ধ করে আওরঙ্গজেবের দূত ঈসা বেগকে বন্দি করেন। ফলে আওরঙ্গজেব তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তােলেন।

১৪. তাৎক্ষণিক করণঃ রাজধানী থেকে দূরবর্তী প্রদেশে অবস্থানকারী শুজা, আওরঙ্গজেব ও মুরাদ ১৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে অসুস্থ পিতার সংবাদ না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা মনে করেন, দারা পিতার মৃত্যু সংবাদ গোপন করে বলপূর্বক সিংহাসন দখল করেছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে।

ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের ধারাবাহিকতাঃ
১. বাহাদুরগড়ের যুদ্ধঃ ঐতিহাসিক হান্টার বলেন, শুজাই সর্বপ্রথম ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে স্বাধীন শাসনকর্তা ঘােষণা করে নিজ নামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে তিনি আগ্রা দখল করতে এলে বাহাদুরগড়ে দারার পুত্র সুলায়মানের নিকট পরাজিত হন।

২. মুরাদের বিদ্রোহঃ ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে মুরাদ নিজেকে গুজরাটের সম্রাট বলে দাবি করে স্বীয় ভগ্নী জাহানারা বেগমকে প্রদত্ত সুরাট বন্দর বিধ্বস্ত করেন এবং তার দেওয়ান মীর আলী নকীকে নিজ হস্তে হত্যা করেন।

৩. মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের চুক্তিঃ ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে মুরাদ নিজেকে সম্রাট দাবি করার পর আওরঙ্গজেবের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এতে সিদ্ধান্ত হয়, যুদ্ধ জয়ের পর মুরাদ সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মীর ও সিন্ধু লাভ করবেন। এমনকি যুদ্ধলব্ধ সামগ্রীর এক-তৃতীয়াংশও পাবেন মুরাদ।

৪. ধর্মাটের যুদ্ধঃ ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের সম্মিলিত বাহিনী ধর্মাটের যুদ্ধে সম্রাটের বাহিনীকে পরাজিত করে।

৫. সামুগড়ের যুদ্ধঃ ধর্মাটের যুদ্ধে জয়লাভের পর সম্মিলিত বাহিনী চম্বল নদী অতিক্রম করে আগ্রার অনতিদূরে সামুগড় প্রান্তরে শিবির স্থাপন করে। ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত দারা ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন কিন্তু এ যুদ্ধে তিনি শােচনীয়ভাবে পরাজিত হন।

৬. মুরাদের মৃত্যুদণ্ডঃ সুযােগ্য আওরঙ্গজেব কৌশলে ভ্রাতা মুরাদকে বন্দি করেন এবং দেওয়ান আলী নকীকে হত্যার দায়ে তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেন। এর পর ১৬৫৮ সালে আওরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন।

৭. খাজোয়ার যুদ্ধঃ শুজার মৃত্যু ও দারার পরাজয়ের পর শুজা সিংহাসনে আরােহণের জন্য পুনরায় অগ্রসর হন কিন্তু তিনি খাজোয়ার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের নিকট পরাজিত হন এবং পূর্বাঞ্চলে পলায়ন করেন। পরে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে আরাকানীদের হাতে নিহত হন।

৮. দারার পরিণতিঃ ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে আজমীরের নিকট দেওয়াইর যুদ্ধে আওরঙ্গজেব দারাকে শেষবারের মতাে পরাজিত করে বন্দি অবস্থায় দিল্লীতে আনেন। অবশেষে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের অভিযােগে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

আওরঙ্গজেবের সাফল্যের কারণঃ
১. আওরঙ্গজেবের যােগ্যতাঃ শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে আওরঙ্গজেবই সর্বাপেক্ষা প্রতিভাবান ও যােগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন। তাই তিনি যােগ্যতা ও কর্মদক্ষতা গুণে অযোগ্য ভাইদের বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করে বিজয় লাভ করেন।

২. অভিজ্ঞ সেনাবাহিনীঃ ঐতিহাসিক হান্টার বলেন, “আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী ছিল অভিজ্ঞ ও সুশৃঙ্খল। তাই আওরঙ্গজেব স্বয়ং সুকৌশলে যুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয়ের মালা ছিনিয়ে নেন।”

৩. ইসলামের প্রতি একনিষ্ঠঃ ইসলামের প্রতি আওরঙ্গজেব ছিলেন একান্ত নিষ্ঠাবান। অপরদিকে দারা ছিল ইসলামের প্রতি উদাসীন। ফলে মুসলমানগণ স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে আওরঙ্গজেবের প্রতি সার্বিক সহযােগিতার হাত প্রসারিত করে।

৪. সম্রাট শাহজাহানের অদূরদর্শী নীতির ফলঃ উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে আওরঙ্গজেবের সাফল্যের মূল কারণ ছিল দারার প্রতি শাহজাহানের দুর্বলতা। শাহজাহান যদি আরােগ্য লাভের পর মৃত্যু সংক্রান্ত মিথ্যা গুজবের প্রতিবাদ করে নিজে পুনরায় শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে অযােগ্য দারাকে অপসারণ করতেন, তাহলে ভ্রাতৃবিরােধ অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যেত।

উপসংহারঃ আল্লাহর ওপর ভরসা এবং আপন শ্রেষ্ঠ বলে উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে শাহজাহান কাজ শুরু করেছিলেন। অত্যন্ত রহস্যময় ও দুঃখজনক ঘটনাবলির মাধ্যমেই তার রাজত্বকালের সূচনা হয়। এজন্য শাহজাহানের জীবনের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক আর. সি. মুজমদার বলেন- Shahjahans' last days were made highly tragic by the outbreak of a terrible was of succession among his sons.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক