অথবা, স্বতঃপ্রতীতিবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ সত্যসম্পর্কীয় সমস্যা জ্ঞানবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। সত্যের অনুসন্ধান করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর তাই জ্ঞানাবস্থার মূল্যায়ন থেকেই জ্ঞানের যথার্থতা বা বৈধতা বা সত্য-মিথ্যাত্ব নিরূপণের প্রশ্ন দেখা দেয়। এই সত্যতা নিরূপণ করতে গিয়ে দার্শনিকগণ কতগুলাে মতবাদ উপস্থাপন করেন। স্বতঃপ্রতীতিবাদ সত্যতা নিরূপণের অন্যতম মতবাদ। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলাে-
স্বতঃপ্রতীতিবাদঃ যে মতবাদ কোন বচনের সত্যতা নিরূপণে স্বতঃপ্রতীতি বা নিঃসন্দিগ্ধতাকে মানদণ্ড বলে মনে করে তাকে বলে স্বতঃপ্রতীতিবাদ (Self-evidence Theory)। এ মতবাদ অনুসারে, কোন বচন যে সত্য, তা আপনা-আপনিই প্রতীয়মান হয়। স্বতঃই বােঝা যায় যে বচনটি সত্য। অর্থাৎ কোন বচন যদি সত্য হয় তাহলে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা আপনা-আপনিই সত্য বলে আমাদের কাছে ধরা পড়তে বাধ্য। কিন্তু যেসব বচনের সত্যতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের চেতনায় ধরা পড়ে না তাদের সত্য বচন বলে অভিহিত করা যায় না। তাই এ মতবাদের অনুগামীরা বলেন, কোন বচনের সত্যতা সেই বচনের ওপরই নির্ভরশীল; বাইরের কোন শক্তির দ্বারা বচনের সত্যতা নির্ণয় করা যায় না। যৌক্তিক চিন্তার মূলসূত্র, বিশুদ্ধ গণিতশাস্ত্র ও নৈতিকতার এমন কতগুলাে স্বতঃসিদ্ধ বিধান রয়েছে যাদের সত্যতার জন্য কোন প্রমাণের প্রয়ােজন পড়ে না। এ সকল বিষয়সম্পর্কিত বচনের প্রাতিভাসিক রূপই আমাদের বলে দেয় বচনটি সত্য না মিথ্যা।
ডেকার্ট ও স্পিনােজা স্পষ্টতা ও পরিস্ফুটতাকে সত্যতার মানদণ্ড হিসেবে মনে করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডেকার্ট মনে করেন, আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি। এ সত্য আমার কাছে খুব স্পষ্ট ও পরিস্ফুট। এ বাক্যের সত্যতা স্বতঃপ্রতীত বলে নিশ্চিত হতে পারা যায় যে, বাক্যটি সত্য। তাই ডেকার্টের মতে, আত্মা বা আত্মজ্ঞান সম্পর্কীয় অবধারণ স্পষ্ট ও পরিস্ফুট এবং সন্দেহাতীতভাবে সত্য। এই আত্মজ্ঞান সম্পর্কীয় অবধারণ থেকে অনিবার্যভাবে স্রষ্টা বা ঈশ্বর ও বহির্জগৎসম্পর্কিত সব ধারণা পাওয়া যায় বলে এ অবধারণ সন্দেহাতীতভাবে সত্য।
স্পিনােজার মতে, ঈশ্বর সম্পৰ্কীয় জ্ঞান চরম বা পরম নিশ্চয়ত্মক জ্ঞান এবং এরূপ নিশ্চয়ত্মক জ্ঞান থেকেই আত্মজ্ঞান বা জগৎসম্পৰ্কীয় জ্ঞান পাওয়া যায় বলে এগুলােও সন্দেহাতীতভাবে সত্য। লক যদিও অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক তথাপি তিনি ডেকার্টের মতাে বলেন যে, স্বতঃপ্রতীতিবােধের বলেই আমরা কোন বাক্যের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহমুক্ত হতে পারি।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সত্যের পরীক্ষা বা মানদণ্ড হিসেবে স্বতঃপ্রতীতি যদিও নির্ভরযােগ্যতার সঙ্গে বিশুদ্ধ গণিত ও আকারগত যুক্তিবিদ্যায় প্রয়ােগ করা সম্ভব হয়ে থাকে, তথাপি একে সত্যতা নিরূপণের একমাত্র নির্ভরযােগ্য মানদণ্ড হিসেবে সর্বক্ষেত্রে পুরােপুরি গ্রহণ করা যায় না বলে স্বতঃপ্রতীতিবাদ একটা সন্তোষজনক মতবাদ নয়।
0 মন্তব্যসমূহ