অথবা, একটি আদর্শ সমাজ গঠনকারী হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, সমাজ সংস্কারক ও নতুন সমাজের স্রষ্টা হিসেবে মহানবী (স)-এর চরিত্র ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।
উপস্থাপনাঃ সমাজ সংস্কারক হিসেবে মহানবী (স) ছিলেন বিশ্বের ইতিহাসে অদ্বিতীয় ব্যক্তি। তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে অশান্ত, পশ্চাৎপদ ও বর্বরতার তিমিরে আচ্ছন্ন আরব সমাজকে তিনি এমন এক সুন্দর সমাজে পরিণত করেন, ধরণীর ইতিহাসে যার কোনাে নযীর নেই। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক রায়মন্ড লার্জ বলেন- The founder of Islam is in fact, the promoter of the first social and international revolution of which history gives mention.
সমাজ সংস্কারক হিসেবে মহানবী (স)-এর কৃতিত্বঃ
১. তাওহীদের আদর্শে সমাজ গঠনঃ ধর্মীয় ক্ষেত্রে নানা অনাচার; পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের মূলােৎপাটন করে সমগ্র সমাজ সংগঠনকে এক আল্লাহতে বিশ্বাসী তাওহীদের আদেশ ঢেলে সাজান।
২. শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজঃ রাসূল (স) বলেন, শুধু জন্মবংশ কিংবা ভাষা বা অঞ্চলের বিচারে মানুষের মর্যাদা ও প্রাধান্য হয় না। তার ভাষায় সকল মানুষ সমান। শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি যিনি আল্লাহর আনুগত্য ও মানুষের কল্যাণকামী। আর এ নীতির ভিত্তিতেই তিনি শান্তিময় সমাজ গঠন করেন।
৩. সামাজিক বৈষম্য নির্মূলঃ আভিজাত্যের অহমিকা, কৌলিন্যের গৌরব প্রভূতির মূলে কুঠারাঘাত করে মহানবী (স) সমাজকে এমনভাবে ঢেলে সাজান যেন সমাজের প্রত্যেক সদস্য পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যায়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই।
৪. মানবতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, মহানবী (স) নানা অনাচার, পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের মূলােৎপাটন করে সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে তাওহীদের আদর্শে রূপায়িত করেন।
৫. অসাম্য দূরীকরণঃ ঐতিহাসিক পি. কে হিট্টি বলেন, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তথা সাদা কালাের দূরত্ব, উচু-নিচুর পার্থক্য, ধনী-গরিবের ব্যবধান ইত্যাদি সামাজিক ব্যাধি মহানবী (স) সমাজ থেকে বিলুপ্ত করেন।
৬. কলহের অবসানঃ মহানবী (স) মদিনার আওস ও খাজরাজ গােত্রের দ্বন্দ্ব কোন্দল মীমাংসা করার ফলে ইহুদি এবং খ্রিস্টানদেরও অনেকে নিজেদের আত্মকলহ ভুলে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে।
৭. ভিক্ষাবৃত্তি উচ্ছেদঃ ঐতিহাসিক খােদা বক্স বলেন, মহানবী (স) ভিক্ষাবৃত্তি ঘৃণা করতেন এবং মানবের শ্রেষ্ঠ হাতকে খাটো করার ঘাের বিরােধী ছিলেন। তাই তিনি ঘােষণা করেন, “উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম”।
৮. মদ জুয়া নিষিদ্ধকরণঃ তৎকালীন আরব সমাজে মদ্যপান ও জুয়াখেলার ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং এটাকে তারা সম্মানজনক কাজ মনে করত। মহানবী (স) মদ জুয়াসহ যাবতীয় ক্ষতিকর খেলাধুলা, আমােদ প্রমােদ নিষিদ্ধ করে ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে সমাজকে রক্ষা করেন।
৯. সুদপ্রথা বিলােপঃ ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, মহানবী (স) আরবের জঘন্য সুদপ্রথা চিরতরে হারাম ঘােষণা করে কর্জে হাসানা পদ্ধতি চালু করেন।
১০. মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণঃ রাসূলে করীম (স) মদিনা সনদের মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করেন।
১১. জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানঃ হযরত মুহাম্মদ (স) এমন আইন প্রবর্তন করেন যাতে সমাজের প্রতিটি সদস্য জীবন ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করে। ফলে ইজ্জত হরণ, চুরি-ডাকাতির আর কোনাে ভয় থাকেনি।
১২. অশ্লীলতা ও অনাচারের মূলােৎপাটনঃ মহানবী (স) সমাজ থেকে যাবতীয় অনৈতিকতা, অশ্লীলতা, অনাচার, পাপাচার, ব্যভিচার ইত্যাদির মূলােৎপাটন করে একটি পবিত্র সুন্দর কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৩. নিষ্ঠুরতার অবসানঃ মহানবী (স) তৎকালীন আরব সমাজে প্রচলিত সকল প্রকার নিষ্ঠুরতা দূর করে শান্তি ফিরিয়ে আনেন।
১৪. নারীর মর্যাদাদানঃ মহানবী (স) নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দান করেন। স্বামী ও পিতার সম্পদে তার অংশ নির্ধারণ করে দেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “জননীর পদতলে সন্তানের বেহেশত”।
১৫. দাসপ্রথা বিলােপঃ তৎকালীন সমাজে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। মনিব দাসদাসীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাত। তিনি ঘােষণা করলেন, দাসদাসীকে আজাদ করার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ আল্লাহর কাছে কিছুই নেই।
১৬ দাসদের উচ্চ মর্যাদাদানঃ দাসদের মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, তাদের উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। হযরত বেলাল (রা)-কে তিনি মুসলিম জাহানের প্রথম মুয়াজ্জিন এবং হযরত যায়েদ (রা)-কে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করেন।
১৭. প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনের অধিকার প্রতিষ্ঠাঃ পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে মহানবী (স) সকলকে উদ্বুদ্ধ করেন। এ
১৮. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ মহানবী (স) সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা চিরতরে বিলুপ্ত করেন।
১৯. শিশু হত্যা রােধঃ জাহেলী যুগের বর্বর আরবরা কন্যাশিশুদের মহা অপমানের প্রতীক বলে মনে করত। তাই কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে পিতা আত্মসম্মানের হানি মনে করে তাকে জীবন্ত কবর দিত। মহানবী (স) এ জঘন্য প্রথা নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন।
২০. এতিম মিসকিনদের অধিকার প্রতিষ্ঠাঃ তৎকালীন সমাজের প্রতিপত্তিশালীরা এতিম মিসকিনদের ওপর জুলুম এবং তাদের ধন সম্পদ আত্মসাৎ করত। মহানবী (স) এতিম মিসকিনদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
২১. আর্থ-সামাজিক অসাধুতা দূরীকরণঃ মহানবী (স) আর্থ-সামাজিক অসাধুতা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি হঠকারিতা, মজুদদারি, কালােবাজারি, নারীর, বহুস্বামী গ্রহণ ইত্যাকার যাবতীয় সামাজিক অনাচার হারাম ঘােষণা করে তা সমাজ থেকে উচ্ছেদ করেন এবং একটি সুন্দর ও পবিত্র সমাজ কাঠামাে প্রবর্তন করেন।
২২. শ্রেষ্ঠ জাতি গঠনঃ মহানবী (স) মুসলিম জাতিকে জ্ঞান বিজ্ঞান, যুদ্ধ, সন্ধি নীতিতে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেন।
২৩. বাক ও বিবেকের স্বাধীনতাঃ মহানবী (স) মদিনা রাষ্ট্রে বাক ও বিবেকের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রয়ােজনবােধে একজন সাধারণ নাগরিকও সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত প্রশাসনিক কর্মকর্তার কার্যকলাপের সমালােচনা করতে পারতেন। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন স্বেচ্ছাচারিতা মুক্ত ছিল।
উপসংহারঃ মহানবী (স)-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রচলিত অমিতাচার বিদূরিত হয়ে কুসংস্কারে নিমজ্জিত আরব সমাজ এক নবজীবন লাভে ধন্য হয়। লেনপুল বলেন, নিঃসন্দেহে মহানবী (স)-কে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক ও জাতির জনক বলা যায়।
0 মন্তব্যসমূহ