বার্গসোঁর মতে বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার পার্থক্য নির্ণয় কর


প্রশ্নঃ বার্গসোঁর মতে বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার পার্থক্য নির্ণয় কর।
অথবা, বার্গসোঁর মতে বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার পার্থক্য তুলে ধর।

ভূমিকাঃ দর্শনের যে শাখা জ্ঞানের উৎপত্তি, স্বরূপ, সীমা, বৈধতা, যথার্থতা ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করে তাকে বলা হয় জ্ঞানবিদ্যা। জ্ঞানবিদ্যা দর্শনের একটি অন্যতম প্রধান শাখা। জ্ঞানের উৎপত্তি কিভাবে হয় দর্শনের একটি অন্যতম প্রধান আলােচ্য বিষয়। আর এ আলােচনা করতে গিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। কেউ বলেছে বুদ্ধি, কেউ বলেছেন অভিজ্ঞতা, কেউ স্বজ্ঞা, আবার কেউ বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা উভয়ই। সুতরাং জ্ঞানােৎপত্তি বিষয়ে আমরা চারটি মতবাদ পাই।

বার্গসোঁর স্বজ্ঞাবাদঃ আধুনিক স্বজ্ঞাবাদের অন্যতম প্রবক্তা হেনরি বার্গসোঁর মতে, স্বজ্ঞা একটি অনবদ্য বৌদ্ধিক সমবেদনা। তার মতে, বুদ্ধি যথার্থ জ্ঞান প্রদান করতে পারে না। এটি কেবল বস্তুর লক্ষণকে বর্ণনা করতে পারে, বস্তুর প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারে না। তিনি বলেন, বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞান বস্তুর প্রতিভাসিক জ্ঞান ব্যতিরেকে কিছুই নয়। বুদ্ধি কখনই দার্শনিক জ্ঞান দিতে পারে না। একমাত্র স্বজ্ঞাই দার্শনিক জ্ঞান দিতে সক্ষম। বার্গসোঁ তার বুদ্ধি ও স্বজ্ঞা সম্পর্কিত আলােচনা “Time & Free will” এবং "Matter and memory" গ্রন্থে আলােচনা করেন।

বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার মধ্যে পার্থক্যঃ বার্গসোঁ তার দর্শনে বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে স্বজ্ঞার ধারণাকে সুস্পষ্ট করেন এবং স্বজ্ঞাকে একমাত্র সত্য অনুসন্ধানের পদ্ধতি হিসেবে মনে করেন।

(১) চরম সত্য প্রকাশেঃ বুদ্ধি আমাদের জ্ঞানের একটি বিশেষ দিক। বুদ্ধির সাহায্যে আমরা জগৎকে জানার চেষ্টা করি। কিন্তু বুদ্ধি আমাদের চরম সত্য নির্ধারণে পর্যাপ্ত পদ্ধতি বা উপায়ে হিসেবে আসে না। একমাত্র স্বজ্ঞাই আমাদের চরম সত্য প্রদান করতে পারে। এজন্য বুদ্ধি সত্যতা অনুসন্ধানের যথার্থ পদ্ধতি নয় বরং স্বজ্ঞাই সত্যতা অনুসন্ধানের একমাত্র উপায়।

(২) বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার তারতম্যঃ বুদ্ধি তত্ত্বের অংশবিশেষ জানে। এটা তত্ত্বকে বিভক্ত করে দেখে। এটা তত্ত্বের সাক্ষাত পায় না, একটি কল্পিত কৃত্রিম প্রতিভাস পায়। বুদ্ধি নিজ কোঠা ছেড়ে অন্য কোঠায় প্রকাশ করতে চায়। বিশেষ ছেড়ে যখন সামান্য গমন করতে যায়, তখন ব্যর্থ। বুদ্ধি ভাসমান জলে বরফ টুকরার সামান্য অংশকে দেখে।

(৩) বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার বাস্তব অবস্থাঃ বার্গসোঁর মতে, আমরা বুদ্ধির যেখানে সীমানা পাই, স্বজ্ঞার সেখানে শুরু হয়। কান্ট তার Critique of Pure Reason-এ দেখান যে, ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের সমতলভূমি ছেড়ে বুদ্ধি যদি তর্কের সাহায্যে এর বাইরে ওড়ার চেষ্টা করে তবে এর প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়। কান্টের Pure Reason বুদ্ধি নয়, বােধি বা স্বজ্ঞা, বুদ্ধির সম্বল তর্ক। এক বুদ্ধিমানের উপস্থাপিত তর্ক অন্য বুদ্ধিমান খণ্ডন করে।

(৪) বুদ্ধি বাহ্যিক, স্বজ্ঞা সার্বিকঃ বার্গসোঁ এর মতে, বুদ্ধি তর্ক করে বাহ্যিক বিষয় নিয়ে, কিন্তু বােধি করে না, বরং অনুভূতি লাভ করে। বুদ্ধি বিষয়কে সাজিয়ে গুছিয়ে পরীক্ষা করে। কিন্তু বােধি চোখের পলকে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের ন্যায় সত্যের মর্মে প্রবেশ করে। বুদ্ধি সত্যরূপ প্রাসাদের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়।

(৫) জীব ও পরম সত্তার সম্পর্ক নির্ণয়েঃ আমরা বিভিন্ন দার্শনিকের মতামত প্রত্যক্ষ করে দেখি যে, জীব ও পরমসত্তার সম্বন্ধ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বুদ্ধি কঠিন অপারগতা দেখায়। আমরা কিন্তু স্বজ্ঞার দ্বারা এ সম্বন্ধ দেখাতে পারি। স্বজ্ঞার দ্বারা দেখাতে পারি যে, জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু সে সম্পর্ক দুই নয়; বরং এক ও অদ্বৈত। কারণ বুদ্ধির সীমানা যেখানে শেষ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও স্বজ্ঞাবাদের বাস্তব মূল্যকে একবারেই অস্বীকার করা যায় না। চরম সত্তার জ্ঞান বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সাহায্যে লাভ করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে স্বজ্ঞার ভূমিকা কার্যকর। বস্তুত আধিবিদ্যক জ্ঞানলাভের জন্য অনেকেই স্বজ্ঞার কার্যকর ভূমিকার কথা বলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক