অথবা, সমাজ জীবনের ওপর পরিবেশের প্রভাব তুলে ধর।
ভূমিকাঃ সমাজজীবন কিছু মৌল উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এই মৌল উপাদান দ্বারাই মূলত সমাজজীবন পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে সমাজজীবন একদিকে যেমন ভৌগােলিক দিক দিয়ে প্রভাবিত হয় তেমনি কখনাে বংশগতি বা জৈবিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তবে সমাজজীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংস্কৃতি বা কৃৎকৌশল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কিছু মৌলিক উপাদান সমাজজীবনকে সঠিক পথনির্দেশনা যেমন দান করে তেমনি সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সমাজজীবনে ভৌগােলিক উপাদান/পরিবেশের প্রভাবঃ সমাজজীবন নানাভাবে প্রভাবিত। এদের মধ্যে ভৌগােলিক পরিবেশ অন্যতম। সমাজবিজ্ঞানে ভৌগােলিক পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী মন্টেঙ্কু সর্বপ্রথম সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলােচনা করেছেন। ভৌগােলিক উপাদান বলতে জলবায়ু ও তাপমাত্রা, মৃত্তিকা, জলের অবস্থান ও গতি, বনাঞ্চল, পশুপাখি, ঋতু, মধ্যাকর্ষণ শক্তি, ঝড় বৃষ্টি প্রভৃতিকে বুঝায়। সমাজজীবনে ভৌগােলিক উপাদনের প্রভাব আলােচনা করা হলাে-
(১) জনসংখ্যার বন্টনঃ ভৌগােলিক পরিবেশ জনসংখ্যার বন্টন ও সভ্যতার বিকাশে যথেষ্ট ভৌগােলিকভাবে সমৃদ্ধ এবং মানুষ যেখানে সহজে জীবিকা অর্জন করতে পারে সেসব অঞ্চলে সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে ওঠে। নীলনদের অববাহিকায় মিশরীয় সভ্যতা, সিন্ধু নদের অববাহিকায় সিন্ধু সভ্যতা এর অন্যতম উদাহারণ। আবার যেসব অঞ্চল ধূ-ধূ মরুভূমি সেসব অঞ্চলে জনসংখ্যার বন্টন যেমন কম, তেমনি সেখানে সভ্যতার বিকাশও তেমন ঘটেনি।
(২) সাংস্কৃতিক প্রভাবঃ ভৌগোলিক পরিবেশ বিভিন্ন দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ব্যপকভাবে সমাজজীবনকে প্রভাবিত করে থাকে। ভৌগােলিক কারণে বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির উপাদানের সাথে আমেরিকার সংস্কৃতির ধরন এক নয়। বিধায় এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য হয় না।
(৩) অর্থনীতিঃ জীবিকার প্রয়ােজনে ফসল উৎপাদনের জন্য চাই উপযােগী আবহাওয়া, জলবায়ু তথা পরিমিত বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা। নানা ধরনের ফসলের জন্য প্রয়ােজন নানা ধরনের ভৌগােলিক পরিবেশ। কেননা মাটি ও জলবায়র বৈশিষ্ট্যের ওপর ওপর ফসলের ধরন, প্রকৃতি ও গুণগত মান নির্ভর করে। সুতরাং ফসলের ওপর ভিত্তি করে আগেকার অর্থনীতি তথা সামাজিক জীবন গড়ে ওঠে।
(৪) নরগােষ্ঠীঃ নরগােষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য ভৌগােলিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনসমষ্টিকে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, বাহ্যিক আকৃতির দিক থেকে সকল মানুষ সমান নয়। সাধারণত শীত প্রধান দেশের মানুষ শ্বেতবর্ণের এবং গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের মানুষ কৃষ্ণবর্ণের হয়ে থাকে। মূলত ভৌগােলিক উপাদান এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ দায়ী।
(৫) অপরাধঃ অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির পেছনে ভৌগােলিক উপাদানকে দায়ী করা হয়। সমাজবিজ্ঞানী লমব্রুসাে (Lombroso) এর মতে, সমতল অঞ্চলের চেয়ে পাহাড়ি ও পার্বত্য এলাকায় অপরাধ তুলনামূলকভাবে বেশি। তিনি আরও বলেন, সমতল অঞ্চলের তুলনায় পাহাড়ি ও পার্বত্য অঞ্চলে ধর্ষণ অপরাধ ও সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধ কম। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি বলে সমতল অঞ্চলে ধর্ষণ অপরাধ বেশি। শীতের দিনে গ্রামাঞ্চলে চুরি বৃদ্ধি পায়।
(৬) পােশাক-পরিচ্ছদঃ পােশাক-পরিচ্ছদও ভৌগােলিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত। শীতপ্রধান এলাকায় মােটা বা গরম কাপড়ের প্রচলন এবং গ্রীষ্ম প্রধান এলাকায় হালকা সুতির কাপড়ের ব্যবহার ভৌগােলিক পরিবেশ দ্বারাই নির্ধারিত হয়। মূলত আবহাওয়া এবং জলবায়ুর বৈচিত্র্যের কারণে সমাজজীবনে প্রভাব পড়ে।
(৭) আবাসস্থলঃ ভৌগােলিক উপাদানের ওপর ঘর-বাড়ির বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে। কারণ ঘরবাড়ি তৈরী করার জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণ যেমন বাঁশ, কাঠ, ছন-খড়, ইট, পাথর প্রভৃতি ভৌগােলিক প্রভাবাধীন। জাপানে প্রায় ভূমিকম্প হয় বলে সেখানে ঘরবাড়ি তৈরীতে ইট-সিমেন্টের তেমন ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না। যেখানে ছন ও খড়ের অভাব অথচ এঁটেলে মাটির সহজলভ্যতা আছে সেখানে মাটির দেয়ালবিশিষ্ট ঘর-বাড়ি রয়েছে।
(৮) যানবাহনঃ যানবাহনের ধরন কি হবে তা ভৌগােলিক পরিবেশ দ্বারা নির্ধারিত হয়। যেমন, বর্ষাকালে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নিম্নভূমিতে ভেলা, নােকা এবং লঞ্চ চলাচল করে। আবার উত্তর পশ্চিম এলাকায় গরু-মহিষের গাড়ির ব্যবহার দেখা যায়।
(৯) মানব প্রকৃতি ও দক্ষতাঃ ভৌগােলিক উপাদান বিশেষ করে তাপমাত্রা, মানব প্রকৃতি এবং দক্ষতার উপর প্রভাব রাখে। হানটিংটনের গবেষণায় লক্ষণীয় যে, ৪০০ ফা. তাপমাত্রায় মানাসক দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। অত্যধিক তাপে মানুষ অস্বাচ্ছন্দ্যবােধ করে। অল্প পরিশ্রমেই মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আবার শীতকালে মানুষ বেশি পরিশ্রম করেও সহজে ক্লান্ত হয় না।
(১০) বিবাহ ও পারিবারিক জীবনঃ গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের ছেলে-মেয়েরা অল্প বয়সে যৌবনে পান। ফলে এ সকল অঞ্চলে অল্প বয়সে বিয়ের প্রয়ােজন হয়। অল্পবয়সে বিয়ে করায় জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ফলে যৌথ পরিবারে ভাঙন সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। মূলত ভােগােলিক উপাদানগুলাে মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ভৌগােলিক অবয়ব মানুষের জীবনকে বিকশিত করার একমাত্র মাধ্যম। আর এর উপাদানগুলাে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে মানুষের জীবনকে অগ্রসর হতে সাহায্যে করে। যদিও বর্তমানে প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক বিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়সাধন করা হচ্ছে তথাপি ভৌগােলিক উপাদান মানুষের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে।
0 মন্তব্যসমূহ