জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর


প্রশ্নঃ মন্তব্যসহ জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদের ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

ভূমিকাঃ আধুনিক দর্শন জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন। যথার্থভাবে দর্শন আলােচনা করতে হলে জ্ঞানবিদ্যার আলােচনা প্রয়ােজন। জ্ঞানবিদ্যার আলােচনাই দর্শন আলােচনার মূল। কাজেই জ্ঞানবিদ্যাকে দর্শনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে দেখা যায়। সুতরাং এ জ্ঞানবিদ্যার আলােচনা আমাদের অবশ্যই করতে হবে। জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে হয় এ প্রশ্নের উত্তর প্রদান করাই জ্ঞানবিদ্যার আলােচনা।

অভিজ্ঞতাবাদঃ অভিজ্ঞতাবাদ একটি অন্যতম জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ। এ মতানুসারে অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। আধুনিক যুগের দার্শনিক বেকন, জন লক, বার্কলি ও হিউম ছিলেন অভিজ্ঞতাবাদের প্রধান সমর্থক। এই মতবাদের প্রথম বীজ বপন করেন বেকন। তবে জন লক হচ্ছেন আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদের জনক। এই মতবাদ অনুযায়ী একমাত্র অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের উৎস। এ ছাড়া জ্ঞান লাভের অন্য কোনাে উপায় নেই। এখন বিভিন্ন দার্শনিকের দৃষ্টিতে অভিজ্ঞতাবাদের ব্যাখ্যা দেওয়া হলাে-

জন লকের অভিজ্ঞতাবাদঃ জন লক অভিজ্ঞতাবাদের একটি সুসংহত ও সুস্পষ্ট রূপ দান করেন বলে অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। তিনি বুদ্ধিবাদের প্রধান পুরােহিত ডেকার্টের অন্তধারণাকে নিমােক্ত যুক্তির সাহায্যে খণ্ডন করেন।

(১) সহজাত ধারণা সকলের মনে একইরূপ থাকে নাঃ মানুষের মধ্যে যদি কার্যকারণ ঈশ্বর, অসীমতা, নিত্যতা ইত্যাদি সম্পর্কে সহজাত ধারণা থাকে, তাহলে তা সকলের মধ্যেই সমানভাবে বিরাজ করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, শিশু, নির্বোধ ও অসভ্য লােকদের মধ্যে এ জাতীয় ধারণা নেই।

(২) বাস্তবতার নিমিত্তে ধারণাঃ কোনাে ধারণা সকলের মধ্যে থাকলেই তাকে অন্তর ধারণা বলা যায়। আগুন সম্পর্কে সকলেরই ধারণা আছে। তবে তা অন্তর ধারণা নয়। এটি অভিজ্ঞতাজাত ধারণা।

(৩) ঈশ্বর ও নৈতিক নিয়ম সম্পর্কে বিভিন্ন মতঃ ধারণা সহজাত হলে তা সবার মধ্যেই একরূপ হবে। কিন্তু দেখা যায়, ঈশ্বর, নৈতিক নিয়ম ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যক্তি ও সমাজভেদে বিভিন্ন রূপ ধারণা রয়েছে।

(৪) অভিজ্ঞতার কল্যাণে ধারণাঃ কোনাে ধারণা সর্বজনস্বীকৃত হলেই তাকে অন্তর্ধারণা বলা যায় না। মানুষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই অন্তর্ধারণা অর্জন করে। জন লক এভাবে ডেকার্টের সহজাত ধারণাকে তার নঞর্থক মতবাদের খণ্ডন করে। সমার্থক মতবাদে তার অভিজ্ঞতাবাদকে উদাত্ত কণ্ঠে ঘােষণা করতে গিয়ে বলেন যে, জন্মের সময়ে মানুষের মন একটা সাদা কাগজ-এর মতাে থাকে এবং তাতে সহজাত ধারণা বলে কোনাে কিছু থাকে না। তার মতে অভিজ্ঞতা আসে দু’টি পথ বেয়ে এবং এ পথ দু'টি হলাে-(১) সংবেদন ও (২) অন্তঃদর্শন।

(১) সংবেদনঃ বহির্জগৎ থেকে যার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন বস্তুর গুণাবলি যেমন রূপ, রস, গন্ধ ইত্যাদির অভিজ্ঞতা অর্জন করি তা হলাে সংবেদন।

(২) অন্তঃদর্শনঃ অন্তঃদর্শনের মাধ্যমে মানসিক ক্রিয়াকলাপ যেমন, প্রত্যক্ষণ, চিন্তন, বিশ্বাস, ভালাে লাগা ইত্যাদি সম্পর্কীয় ধারণা আমরা পেয়ে থাকি।

জন লক বলেনঃ অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। অভিজ্ঞতা-পূর্ব অন্তর ধারণা বলতে কিছু নেই। তাই লক বলেন, “বুদ্ধিতে এমন কিছুই নেই পূর্বে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ছিল না।” অভিজ্ঞতাবাদী লক অবশ্য দ্রব্য, আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন।

বার্কলির অভিজ্ঞতাবাদঃ তার অভিজ্ঞতাবাদের মাধ্যমে বলেন, জগতের সকল বস্তুই সংবেদন ও ধারণা সৃষ্টি মাত্র। বস্তুর কোনাে মন-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। বস্তুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ-নির্ভর। সংবেদন ও ধারণাই জ্ঞানের প্রকৃত উৎস। বার্কলী বলেন, গুণের আধার হিসেবে বস্তর অস্তিত্ব নেই; মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের মধ্যেও কোনাে পার্থক্য নেই। উভয় প্রকার গুণই মনের ধারণা মাত্র। তিনি কেবল মন ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন এবং বলেন জগতের বস্তুসমই মনের ধারণা ছাড়া কিছুই নয়। অর্থাৎ বস্তুর অস্তিত্ব মন-নির্ভর।

ডেভিড হিউমের অভিজ্ঞতাবাদঃ তিনি একজন চরম অভিজ্ঞতাবাদী। তার মতবাদের পরিণতি হচ্ছে সংশয়বাদ। তিনি বলেন, যেহেতু দ্রব্য, আত্মা ও ঈশ্বরকে অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায় না, তাই এদের কোনাে অস্তিত্ব নেই। তার মতে আমাদের সকল জ্ঞান আসে ইন্দ্রিয়জ এবং ধারণা থেকে। ইন্দ্রিয়জ হচ্ছে বাহ্য ও অন্তর সংবেদন। এই সংবেদন সজীব ও স্পষ্ট। এই সংবেদনের ক্ষীণ ও অস্পষ্ট মানসরূপই হচ্ছে ধারণা। ইন্দ্রিয়ৎ থেকেই ধারণার উৎপিত্ত। যার ইন্দ্রিয়ৎ নেই তার ধারণাও নেই। ধারণা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। এই ধারণাই জ্ঞানের উপকরণ। এই ধারণাগুলাে তিনটি অনুষঙ্গ নিয়মানুসারে (সান্নিধ্য নিয়ম, সাদৃশ্য নিয়ম ও পারম্পর্য নিয়ম) সংযুক্ত হলে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। তবে কোনাে জ্ঞানই সুনিশ্চিত নয়, সব জ্ঞানই সম্ভাব্য।

সমালােচনাঃ নিম্নোক্ত কারণে অভিজ্ঞতাকে সন্তোষজনক বলা যায় না-

(১) অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উপায় নয়ঃ জ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও মনের যুক্ত অবদান রয়েছে। অভিজ্ঞতালব্ধ সংবেদনকে মন তার আকার ও মৌলিক ধারণার সাহায্যে জ্ঞানের স্তরে উন্নীত করে থাকে।

(২) লকের অভিজ্ঞতাবাদ অমনােবৈজ্ঞানিকঃ লক বলেছেন ‘মন’ প্রথমে নিষ্ক্রিয় এবং পরে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মন সব সময়ই সক্রিয়।

(৩) বার্কলির মতবাদটি অমনােবৈজ্ঞানিকঃ বার্কলির মতে বস্তু ও সংবেদন অভিন্ন। কিন্তু আসলে বস্তু ও বস্তুরজ্ঞান এক নয়। বার্কলির অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ-নির্ভর মতটি প্রমাণসাপেক্ষ নয়।

(৪) বস্ত ও ধারণা পথক নয়ঃ লক বস্তু ও ধারণার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা ধারণাকে প্রত্যক্ষভাবে জানি, আর বস্তুকে জানি পরােক্ষভাবে। কিন্তু বস্তুকে প্রত্যক্ষভাবে না জানলে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।

(৫) লক সহজাত ধারণা অস্বীকার করেছেনঃ সহজাত ধারণা না হলেও জনাের সময় অন্তত একধরনের সহজাত প্রবণতা থাকে, যার ফলে একই পরিবেশে দু’টি শিশুর মন দু’ভাবে গড়ে ওঠে।

(৬) হিউমের মতেঃ তার মতে বস্তুর প্রকাশ জানা গেলে বস্তুকে জানা সম্ভব হয়। বস্তুর প্রকাশকে জানতে পারলে বস্তুকে জানাও সম্ভব, কারণ প্রকাশের মধ্যদিয়েই বস্তু সত্তার স্বরূপ উদঘাটিত হচ্ছে।

এ মত কি সন্তোষজনকঃ জ্ঞানের উৎস হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ সন্তোষজনক নয়। অনেকের মনে অভিজ্ঞাতাবাদ একটি চরম মতবাদ। কেননা এটি জ্ঞানের ক্ষেত্রে শুধু অভিজ্ঞতাকেই নির্দেশ করে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার মূল্য আছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু অভিজ্ঞতা সবকিছুর জ্ঞান দিতে পারে না। বাস্তব জীবন আমরা দেখতে পাই যে, ঈশ্বর, আত্মা, মন, ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ের কোনাে অভিজ্ঞতা আমরা পাই না কিন্তু তবুও এগুলাে অস্তিত্বশীল। আমাদের মন আছে বলেই আমরা কোনাে কিছু চিন্তা করতে পারি, উপলব্ধি করতে পারি, কোনাে ইচ্ছা। করতে পারি। কিন্তু অভিজ্ঞতা দিয়ে এগুলােকে কোনােমতেই ব্যাখ্যা করা যাবে না। তাই আমাদের এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, জ্ঞানের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ সন্তোষজনক মতবাদ নয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও অভিজ্ঞতাবাদের ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট রয়েছে, তথাপি এই মতবাদকে সন্তোষজনক হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস নয়। জ্ঞানের উৎস হিসেবে বদ্ধির গুরুতুকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কান্ট তার বিচারবাদের জ্ঞানের উৎস হিসেবে অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি উভয়ের প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক