আত্মগত ভাববাদ ও বস্তুগত ভাববাদের মধ্যে পার্থক্য দেখাও


প্রশ্নঃ আত্মগত ভাববাদ ও বস্তুগত ভাববাদের মধ্যে পার্থক্য দেখাও।
অথবা, আত্মগত ভাববাদ ও বস্তুগত ভাববাদের মধ্যে পার্থক্য কর।

ভূমিকাঃ যা জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তুর সম্পর্ককে প্রকাশ করে তাকে বলে জ্ঞান। যিনি জানেন তাকে জ্ঞাতা এবং যে বস্তুকে জানা হয়, তাকে বলা হয় জ্ঞেয়বস্ত। জ্ঞানের স্বরূপকে জানতে হলে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তুর স্বরূপ ও সম্পর্ককে জানা একান্ত প্রয়ােজন। জ্ঞানের স্বরূপ তথা জ্ঞাতা ও জোরবস্তুর স্বরূপ ও সম্পর্ককে কেন্দ্র করে প্রধানত দুটি মতবাদের উদ্ভব হয়েছে, তন্মধ্যে ভাববাদ অন্যতম। জ্ঞানতাত্ত্বিক আলােচনার ক্ষেত্রে ভাববাদের সুস্পষ্ট প্রকাশ যদিও আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে বার্কলির আত্মগত ভাববাদে দেখা যায়, তথাপি এর প্রথম প্রকাশ ঘটে প্রাচীন গ্রিক দর্শনে।

ভাববাদের সংজ্ঞাঃ যে মতবাদ অনুসারে জ্ঞেয়বস্তু মন বা চেতনার ওপর নির্ভরশীল তাকে ভাববাদ বলে। ভাববাদ মন নিরপেক্ষ, বস্তুজগতের কোনাে অস্তিত্ব স্বীকার করে না। এ মতবাদ অনুসারে মনই মৌলিক উপাদান, বস্তুজগতের কোনাে অস্তিত্ব নেই। ভাববাদ অনুসারে, ভাব বা ধারণা বা ঈশ্বরের জ্ঞানের বিষয় হিসাবে বিদ্যমান। ভাববাদ এমত পােষণ করেন যে, বিশ্বজগতের মূল উপাদান মানসিক বা আধ্যাত্মিক। ভাবাবাদ সমস্ত বস্তুর সৃষ্টির মূলে মন, ধারণা, চিন্তা বা আত্মার কথা বলে। ভাববাদের প্রধান সূত্র হচ্ছে আঙ্গিক সমগ্রতা। ভাববাদীরা জগত প্রক্রিয়ায় আঙ্গিক ঐক্যের এবং সত্য সম্পর্কীয় মতবাদে সংগতিবাদের ওপর গুরুত্ব দেয়।

তত্ত্ববিদের দিক থেকেঃ তত্ত্ববিদের দিক থেকে ভাববাদ হলাে এমন একটি সত্তা সম্পর্কীয় মতবাদ, যে মতবাদ ভাব, ধারণা বা আত্মাকে একমাত্র পৃথক সত্তা বলে মনে করে। ভাববাদ অনুযায়ী সত্তার স্বরূপ ভাবাত্মক। দার্শনিক প্যাট্রিক তার Introduction to philosophy গ্রন্থে বলেন, মন হলাে প্রকৃত সত্তা এবং বস্তু হলাে অভ্যাস মাত্র। ভাববাদীরা আত্মা, চেতনা চিন্তার সাহায্যে বিশ্বজগতের ব্যাখ্যা দেয় বলে ভাবাবাদকে আর আধ্যাত্মিক মতবাদ বা আধ্যাত্মবাদও বলা হয় । তাদের মতে, বিশ্বজগতের মূল উপাদান হলাে মন, চিন্তা বা আধ্যাত্মিক শক্তি।

জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকেঃ জ্ঞানতাত্ত্বিক দিকে থেকে ভাববাদের মূল কথা এটাই যে, বাহ্যবস্তুর মননিরপেক্ষ কোনাে সত্তা নেই। ব্যহ্যবস্তু মানুষ বা ঈশ্বর উভয়েই করে না কারাে মন বা জ্ঞানের বিষয়রূপে বিদ্যমান। এই মতবাদ অনুসারে জ্ঞেয় বস্তুর প্রকৃত সত্তা নয়। ভাবের প্রতিকৃতি মাত্র।

আত্মগত ভাববাদ ও বস্তুগত ভাবাদের মধ্যকার বৈসাদৃশ্যসমূহ/ পার্থক্যসমূহঃ আত্মগত ভাববাদ ও বস্তুগত ভবািবাদের মধ্যকার পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য আলােচনার আগে আমাদের এদের সংজ্ঞাগত পার্থক্য নিয়ে আলােচনা করা দরকার। নিম্নে আত্মগত ভাববাদ ও বস্তুগত ভাবাদের সংজ্ঞা উল্লেখপূর্বক পার্থক্যসমূহ / বৈসাদৃশ্যসমূহ দেয়া হলাে-

আত্মগত ভাববাদের সংজ্ঞাঃ আত্মগত ভাববাদের আসল কথা হলাে, এই জগত ও জগতের যাবতীয় বস্তুর অস্তিত্ব মনের ওপর নির্ভরশীল। যাকে আমরা বস্তু বলে মনে করি তা আসলে জ্ঞাতার মনের ধারণা। এই মতবাদ অনুসারে বাহ্যবস্তুর কোনাে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। কেবল মনেরই অস্তিত্ব আছে। জর্জ বাকলি আত্মগত ভাববাদের প্রধান প্রবক্তা তার মতে, যে সকল বস্তু আমরা দেখি তা কতকগুলাে গুণের সমষ্টিমাত্র। এ গুণগুলাে আমদের মনের ধারণা ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব কেবল মন বা মনের ধারণাই বাস্তব বা 'Real' ও অস্তিত্বশীল। এজন্যই বার্কলি বলেন, অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর। কোনাে কিছু অস্তিত্বশীল হওয়া বলতে বুঝায় একটি প্রত্যক্ষিত হওয়া।

বস্তুগত ভাবাদঃ বস্তুগত ভাববাদ অনুসারে মন ও বস্তু উভয়ের অস্তিত্ব আছে অর্থাৎ বাহ্যবস্তু মনের ধারণা নয়; বরং জ্ঞানের বিষয়রূপে বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা আছে। বিশিষ্ট দার্শনিক হেগেল এই মতবাদের প্রবক্তা। এই মতবাদের জ্ঞানের অপরিহার্য বিষয়রূপে জাগতিক বস্তুকে স্বীকার করা হয় বলে একে বস্তুগত ভাববাদ বলে হেগেলের মতে প্রকৃতি বা জড়বস্তু ও মন বা বুদ্ধি যদিও এক ও অভিন্ন, তথাপি তিনি প্রকৃতি বা জড়বস্তুকে বুদ্ধির অধীনে রেখেছেন। হেগেলের মতে, যা বাস্তব তাই বৌদ্ধিক; যা বৌদ্ধিক তাই বাস্তব।

(১) আত্মগত ভাববাদ অনুসারে জড় জগতের অস্তিত্ব, ব্যক্তিমানের ধারণার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদ অনুসারে পরমাত্মাই নিজেকে এই অবসিক জগত পরমাত্মার ধারণা। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদ তার এ প্রকাশের প্রয়ােজনেই বস্তুজগতের সৃষ্টি।

(২) আত্মগত ভাববাদ অনুসারে জগত পরমাত্মার ধারণা। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদ অনুসারে জগত পরমাত্মার প্রকাশ।

(৩) আত্মগত ভাববাদীরা মনে করেন বস্তুর নিজস্ব কোনাে অস্তিত্ব নেই। সকল বস্তুই মনের ওপর নির্ভরশীলী। অপরপক্ষে, বস্তুগত ভাববাদীরা মনে করেন, বস্তুর স্বকীয় অস্তিত্ব আছে। এটি পুরাপুরি মনের ওপর নির্ভরশীল নয়।

(8) আত্মগত ভাববাদ মন বা আত্মার ওপর জোর দেয়। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদ মন, পরমাত্মা ও বস্তুর ওপর জোর দেয়।

(৫) আত্মগত ভাববাদী দার্শনিক বার্কালির মতে, অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর। আর বস্তুগত ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের মতে যা বাস্তব তাই বৌদ্ধিক, যা বৌদ্ধিক তাই বাস্তব।

(৬) আত্মগত ভাববাদের প্রধান বক্তব্য হলাে অস্তিত্বশীল হওয়া মানেই প্রত্যক্ষিত হওয়া। অপরপক্ষে, বস্তুগত ভাববাদে বস্তুর অস্তিত্বের জন্য প্রত্যক্ষণের দরকার হয় না। এটি নিজেই অস্তিত্বশীল।

(৭) আত্মগত ভাববাদ আত্মনির্ভর বা মাননির্ভর। পক্ষান্তরে, বস্তুগত ভাববাদ হলাে বস্তুনির্ভর।

(৮) আত্মগত ভাববাদ অনুসারে আত্মা বা মন একমাত্র আদিম সত্তা। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদ অনুসারে বস্তু ও মন উভয়ই জগতের আদিম সত্তা।

(৯) আত্মগত ভাববাদ জড়ের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদ জড়ের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে।

(১০) আত্মগত ভাববাদেবস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য ঈশ্বরের শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদে বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য ঈশ্বরের শরণাপন্ন হতে হয় না।

(১১) আত্মগত ভাববাদ অনুযায়ী বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। এগুলাে মনের ধারণার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদ অনুযায়ী ধারণার মাধ্যমে বস্তুর অস্তিত্ব নির্ণয় করা যায় না, বরং বস্তু আছে বলেই এর অস্তিত্বশীল।

(১২) আত্মগত ভাববাদের বস্তুর গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদে বস্তুর গুণের কোনাে উল্লেখ নেই।

(১৩) আত্মগত ভাববাদের অনুসারে আত্মা বা মন একমাত্র আদিম সত্তা। কিন্তু বস্তুগত ভাববাদ অনুসারে বস্তু ও মন উভয়েই জগতের আদিম সত্তা।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আত্মগত ও বস্তুগত ভাববাদীরা যদিও তাদের স্ব-স্ব মতবাদের পক্ষে অনেক যুক্তি দাড় করেছিল। তথাপিও তাদের মতবাদ পুরােপুরি সন্তোষজনক একথা বলা যায় না। বার্কলির আত্মগত ভাববাদ সন্তোষজনক নয়; কারন তিনি অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর বলেও শেষ পর্যন্ত মন ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেন। এটি এক ধরনের স্ব-বিরােধিতা। কারণ মন ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক