আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার কর


প্রশ্নঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার কর।

অথবা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের গঠনকৌশল বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) বাংলা সাহিত্যের একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। বিশ শতকের- ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের পটভূমিকায় সাহিত্যের ক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আবির্ভাব। সাহিত্যে নতুন টেকনিক আনয়নে- কী ভাষায়, কী বাক্য ও শব্দ গঠনে কিংবা শৈলী ও ভঙ্গিতে, বিষয়ের সংবীক্ষণ ও উপস্থাপনায়, সর্বোপরি আত্মমগ্ন চেতনার স্বাক্ষর পরাবাস্তব প্রকাশে তৎকালীন প্রজন্মের কিছু তরুণ তাদের কৃতির স্বাক্ষর রাখেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই প্রতিভাবান তরুণদের একজন। লেখকের অনন্য কথাভঙ্গির বিন্যাস পাঠককে আকষ্ট করে পুরােদস্তুর। অভিনব চরিত্র সৃষ্টি, শানিত সংলাপ, বিচিত্র বিষয়ভাবনা ও রচনাকৌশল তার রচনার বৈশিষ্ট্য। আখতারুজাজামান ইলিয়াস তার ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে বিষয়ের অভিনবত্বের পাশাপাশি নবআঙ্গিকে গড়েছেন শিল্পসৌকর্য। এ উপন্যাসে দৈশিক ও কালিক ভাবকল্পটি এক অভিনব স্থাপত্যে বিন্যস্ত। চরিত্র চিত্রণে, ভাষার ব্যবহারে, ঘটনাপ্রবাহে তিনি বাস্তবতাকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন এবং পেরেছিলেন।

উপন্যাসের বিষয়বস্তুঃ বিচূর্ণিত, খণ্ডিত, তমসাচ্ছন্ন সময়ের বৃত্তবদ্ধতা থেকে মুক্তি-প্রত্যাশী জাতীয় অস্তিত্বের সম্পূর্ণতা সন্ধানের শিল্প-অভিপ্রায়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ (১৯৮৬) স্বাধীনােত্তর কালখণ্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এ-উপন্যাসের পটভূমিও উনসত্তরের উতাল সমাজ-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু ঔপন্যাসিকের জীবনজিজ্ঞাসার সর্বমুখিতা উপন্যাসবিধৃত চেতনাকে নির্দিষ্ট কালপরিসর থেকে মুক্তি দিয়েছে। আত্মরতির অন্ধকার থেকে মধ্যবিত্ত মানসের ক্রমমুক্তির ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রাণসঞ্চারী ভূমিকার স্বরূপ নিপুণ দক্ষতায় উন্মােচিত হয়েছে এ উপন্যাসে।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নব্য-উপনিবেশ কবলিত পূর্ব বাংলার নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনের বিস্তৃত পরিসর চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসকে এপিক চারিত্রধর্মে উন্নীত করেছে। উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে মূল দুটি স্রোত বিদ্যমান। এক. নগর জীবন যার জটিল ও দ্বন্দ্বময় চেতনা গড়ে উঠেছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, উনুলিত জনস্রোত, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ এবং স্বৈরশাসনের অনুগ্রহপুষ্ট দালাল-মহাজনের সমবায়ে। শােষক-শােষিতের সম্পর্ক নিরূপণ সূত্রেই শ্রেণি-সংঘাতের অভিজ্ঞতা জাতীয়বাদী আন্দোলনের সঙ্গে সমীকৃত হয়েছে। ঘটনার এই ধারার কেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছে আত্মভুক চেতনালােক থেকে গণআন্দোলনের দিকে ক্রম-অগ্রসরমান ওসমান গণি, ভাসমান শ্রমিক গণঅভ্যুত্থানের স্বতঃস্ফূর্ত সৈনিক খিজির আলি এবং পাকিস্তানি শােষকশক্তির পদাঙ্ক-অনুসারী রহমতউল্লাহ। দুই. সামন্তচেতনা ও বুর্জোয়া ভাবাদর্শের দ্বন্দ্বময় বৈশিষ্ট্যে গঠিত গ্রামজীবন যেখানে ভূমিনির্ভর জোতদার এবং ক্ষুদে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ােশ্রেণির সঙ্গে বর্গাচাষি ও বিত্তহীনের শ্রেণিদ্বন্দ্ব অনিবার্যভাবেই শ্রেণিসংঘাতে পরিণত হয়। উপন্যাস কাহিনির স্রোতের দুই বিপরীত মেরুতে রয়েছে আনােয়ার, চেংটু, করমালি, আলিবক্স এবং খয়বার গাজী। একটি সময় পরিধির সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের সমগ্রতা সৃষ্টির প্রয়ােজনে নগর ও গ্রামের জীবনপ্রবাহকে অখণ্ড তাৎপর্যে রূপায়িত করেছেন ঔপন্যাসিক।

ষাট সালের দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও আন্দোলনের সাক্ষী ‘চিলেকোঠার সেপাই'। প্লট মূলত উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। গল্পের প্রধান চরিত্র রঞ্জু ওরফে ওসমান, ওসমানের বন্ধু আনােয়ার আর আলতাফ। আছে রিকশা শ্রমিক বস্তি বাসিন্দা খিজির। আনােয়ার বামপন্থি আর আলতাফ, ডানপন্থি আনােয়ার আর আলতাফের কথােপকথনের মাধ্যমে লেখক অনেক জটিল রাজনৈতিক জটিলতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। গল্পের ফোকাস কখনাে ছিল হাড্ডি খিজিরের ওপর, কখনাে বা আনােয়ারের ওপর। তবে পুরাে গল্পে অস্তিত্ব ছিল ওসমানের। ঢাকার এক ঘিঞ্জি গলির মধ্যে ওসমানের বাস। তার বন্ধু আলতাফ, আনােয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে কিন্তু ওসমান কোনাে কিছুতেই নেই। সে যেন চিলেকোঠাতে বন্দি। লেখক ওসমান চরিত্রটিকে রহস্যময় করে তৈরি করেছেন। ওসমান যে বাসায় ভাড়া থাকে সেটা আবার আইয়ুবপ্রেমী মহাজন রহমতউল্লাহর। খিজির ছোটোবেলা থেকে রহমতউল্লাহর খেয়ে মানুষ শ্রমিক হিসেবে থাকে তার গ্যারেজে। কিন্তু এই খিজিরই একসময় হয়ে ওঠে বিপ্লবী। বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সাথে সাথে খিজির তার মহাজন রহমতউল্লাহর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলে। সৈনিকের গুলিতে নিহত হয় খিজির। উপন্যাসে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দুটি প্রধান আঙ্গিক হলাে ব্যক্তি ও সমষ্টি। ওসমান নামক আত্মকেন্দ্রিক চরিত্রের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে চিলেকোঠার ব্যক্তিমানস। আর সমষ্টি তথা শােষিত শ্রেণির মানুষরা এসেছে মিছিলের রূপে, সংগ্রামী ঐকতান নিয়ে। উপন্যাসের প্রথমে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আবু তালেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আমরা পরিচয় পাই ওসমান, আলাউদ্দিনস, হাড্ডি খিজির, রহমতউল্লাহর। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ একসূত্রে গ্রথিত হয়েছে এই উপন্যাসে। নগরকেন্দ্রিক মুসলিম লীগপন্থি নব্য সুবিধাভােগী শ্রেণির দ্বন্দ্ব ও গ্রামকেন্দ্রিক আইয়ুবী গণতন্ত্রীদের দৌরাত্ম ও শশাষণ এই উপন্যাসের উপজীব্য।

এ উপন্যাসের বিষয়কল্পনার মূলে মধ্যবিত্তের আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মরূপান্তরের স্বরূপ অন্বেষণের প্রেরণাই মুখ্য। আশির দশকের রাজনীতিপ্রবাহ, সেনাতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের বিনাশী কর্মধারা, মধ্যবিত্তের দোদুল্যমান প্রতিবাদ ও সংগ্রাম, রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের আদর্শগত দূরত্ব, দ্বিধাবিভক্তি প্রভৃতির বাস্তব অভিজ্ঞতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে উত্তাল সময়খণ্ডের সমাজ-রাজনৈতিক সত্য-অন্বেষায় উদ্বুদ্ধ করেছে।

উপন্যাসের চরিত্রায়ন-কৌশলঃ ‘চিলেকোঠার সেপাই' লেখকের অসাধারণ একটি উপন্যাস। তার এই সার্থক উপন্যাস সৃষ্টির পিছনে সবচেয়ে বড়াে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তার চরিত্র চিত্রণের অসাধারণ দক্ষতা। তিনি তার নিপুণ হাতে চরিত্রগুলাে সৃষ্টি করে ব্যতিক্রমী শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেছেন। ওসমান, আনােয়ার, আলাউদ্দিন, হাড্ডি খিজির, আলীবক্স, জালাল মাস্টার, রানু, রঞ্জু, মকবুল হােসেন প্রভৃতি সবগুলাে চরিত্রই প্রায় নিপুণভাবে সেই সময়ের মানসকে ধারণ করে আছে। চরিত্রগুলােকে লেখক তীক্ষদৃষ্টিতে দেখে তার ভেতর থেকে সত্য ও বিশিষ্টতা বের করে এনেছেন।

ওসমান চরিত্রটিকে এ উপন্যাসের প্রতীকী ও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উনসত্তরের সংগ্রাম ও মিছিলে তরঙ্গিত রাজনৈতিক শহর ঢাকা। মধ্যবিত্তের ব্যক্তিসর্বস্ব, আত্মপ্রেম ও আত্মনিগ্রহপরায়ণ চেতনা প্রবল গণআন্দোলনের টানে কীভাবে চিলেকোঠার বিচ্ছিন্ন জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে, ওসমান গনি তার দৃষ্টান্ত। উনুলিত, আমুগ্ধ, বিবরবাসী মধ্যবিত্তের প্রতিভূ ওসমান। কেরানি ওসমান পুরাতন ঢাকার এক চিলেকোঠার ভাড়াটে বাসিন্দা। সে উনলিত-অস্তিত্ব, তার পরিবারের অন্য সবাই ভারতের অধিবাসী। ওসমানের মধ্যে যে আত্মমুগ্ধতা ও স্মৃতিক্লিষ্টতার বিন্যাস ঘটেছে তা সামন্ত জীবনের টানে নয়- বিচূর্ণ, ভগ্ন বর্তমানের অসংগতিজাত। গণঅভ্যুত্থানের প্রথম পর্যায়ে অনেকটা নির্লিপ্ত দর্শকের মতাে ওসমানের গতিবিধি। সে রাজনীতি-সচেতন অথচ আত্মমগ্ন তার মানসগড়নের মধ্যেই এক ধরনের অক্রিয়তা বিদ্যমান। কিন্তু সংগ্রামে-মিছিলে-রক্তপাতে শিহরিত ঢাকার বহির্জীবন তাকে আকর্ষণ করে। ওসমান ও তার পরিপার্শ্ব এবং পরিচিতের সীমার মধ্যেই উপন্যাসের মূল ভাষ্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। ফলে ওসমানের প্রতি লেখকের মনোেযােগ ছিল সবচেয়ে বেশি। সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে ওসমানও মধ্যবিত্তের সন্তান। সত্তা বিচ্ছিন ওসমানকে লেখক ৬৯ এর শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সে সব দেখে, সব শােনে, মিটিং এ যায়, তবুও যেন সেসব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, চিলেকোঠার চার দেয়ালে সে বন্দি।

হাড্ডি খিজির এ উপন্যাসের এক অসাধারণ চরিত্র আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় ভরপুর এ চরিত্রটি। ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসের শিল্পসম্মত প্রতিভূ হাডিড খিজির। রহমতউল্লাহর মতাে খয়বার গাজীও পাকিস্তানি শাসকচক্রের সেবাদাস। বর্গাচাষিদের নির্মমভাবে শােষণ করে সে। তার নির্দেশে গ্রামাঞ্চলের বর্গাচাষিদের গরু চুরি করে জমা করা হয় চরের এক নিরাপদ আস্তানায়। ফলে গ্রামের মানুষ এক সময় ক্রুদ্ধ হয়ে আলিবক্সের নেতৃত্বে পুড়িয়ে দেয় খয়বার গাজীর ট্যান্ডল হােসেন আলীর আস্তানা। চেংটুর মধ্যেই শ্রেণি-স্বভাবের স্বতঃস্ফুত বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত। বিপ্লবী কর্মী আলিবক্স তার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হলেও চেংটুর স্বভাবে খিজিরের সমধর্মিতা বিদ্যমান। সংগঠিত জনতা অতঃপর গ্রাম্য কুসংস্কারের উৎস বৈরাগীর ভিটা পরিষ্কার করে গণশত্রু খয়বার গাজীর বিচারের লক্ষ্যে গণআদালতের আয়ােজন করে। খয়বর গাজী জুম্মার নামাজের প্রার্থনা করে আদালতের কার্যক্রম বিলম্বিত করে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের মিছিল এসে বিনষ্ট করে দেয় গণআদালতের ‘স্পিরিট'। খয়বার গাজীর মৃত্যু দণ্ডাদেশ গণআদালত আর কার্যকর করতে পারে না। খয়বর গাজী পালিয়ে সদ্য জেল ফেরত আওয়ামী লীগ নেতার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় চেংটুকে।

আনােয়ারের মধ্যে সদর্থক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বিধৃত হয়। গণআন্দোলনের নেতৃত্ব ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাসী সংগঠনসমূহের দীর্ঘ সংগ্রামের গতি হয় বাধাগ্রস্ত। তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি গণসংগ্রামের উদ্দেশ্য থেকে ক্রমান্বয়ে দূরবর্তী হতে থাকে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জাতীয় রাজনীতির এই অন্তঃস্বরূপকেও প্রত্যক্ষ করেছেন নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। ঊনসত্তরের প্রবল গণআন্দোলনের টানে জাতীয় মুক্তি সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হলেও সাধারণ মানুষের জীবনপ্যাটার্নের গুণগত পরিবর্তন দুঃস্বপ্নই থেকে যায়। ওসমানের আত্মরূপান্তরে এ কারণেই সম্ভবত তার শ্রেণি-সত্তার বিলুপ্তি নির্দেশ করেন ঔপন্যাসিক বাঙালির মুক্তি-আন্দোলন শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও সংগ্রামে পরিণত হয়।

দৃষ্টিকোণের ব্যবহারঃ ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে এপিক ফর্মের চিরায়ত রূপের মধ্যেই আধুনিক জীবনের জটিল সংকটকে রূপ দিয়েছেন তিনি। নির্দিষ্ট কালখণ্ডের মানবিক অস্তিত্বের সংঘর্ষ ও সামঞ্জস্য সৃষ্টির টানাপােড়েন দক্ষতার সঙ্গে রূপায়িত হয়ে। এ উপন্যাসে অনুভব করা যায় শহর-গ্রামের জীবন-স্পর্শী মানুষের সংঘাতময় অন্তঃস্পন্দন। বিচিত্রধর্মী ঘটনা, নানা-মাত্রিক চরিত্র এবং উৎকণ্ঠিত সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে বিস্ফোরণ-উন্মুখ এক আত্মসত্তার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন ওপন্যাসিক।

সর্বজ্ঞ ঔপন্যাসিকের অবলােকন ওসমানের দৃষ্টিকোণের সঙ্গে সমীকৃত হয়ে ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ নির্মাণ করেছে এবং এই ঘটনাপ্রবাহ (stream of events) সমান্তরাল দুটি রেখায় বিন্যস্ত হয়েছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকালীন উত্তাল রাজনৈতিক শহর ঢাকা এবং শ্রেণিসংঘাতদীর্ণ গ্রামীণ জনপদের আশ্রয়ে নির্মিত হয়েছে উপন্যাসের বহির্ঘটনাবৃত্ত। ওসমানের আত্মসন্ধান, আত্মরক্তক্ষরণ, ও আত্ম-উজ্জীবনের অন্তঃপ্রবাহী চেতনাস্রোত গড়ে তুলেছে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ -এর মৌল জীবনার্থ। ঘটনার সমান্তরাল দুই রেখার সংকর্যে ও সংঘর্ষে নির্মিত হয়েছে এ উপন্যাসের অখণ্ড জীবনবৃত্ত।

ভাষা ও সংলাপঃ ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসের অন্যতম দিক হলাে এর ভাষা ও সংলাপের ব্যবহার। বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ভাষাগুলােকে লেখক রূপ দিয়েছেন সংগ্রামী স্লোগানে

“আটকুইড়া হিজরা মরদ, পােলাপানের তকলিফ বুঝবাে ক্যামনে? নর্দমার মইদ্যে পােলায় গইড়া গেলে তুলব কেঠায়?” [বস্তিবাসীদের ভাষা]

“খানকির বাচ্চা না হইলে রিকশা চালাইবার কাম কেউ রয় না; মহাজনরে ঠকাইবাে হালারা থাকে খালি হেই তালে।” [রিকশার মহাজনের ভাষা]

“ছােটো থাকতে দাদার কাছে শুনছি চান্দের পয়লা সাত দিনের মধ্যে বৈরাগীর ভিটার বট বিরিক্ষের এই পুরানা বাসেন্দা উত্তরের মুখে উড়াল দিলে গাঁয়ের মানুষ ভয়ে সিটকা লাগছে, বড়লােকেরা মিলাদ দিচ্ছে, শিরনি দিচ্ছে, মানত করেছে। [গ্রামাঞ্চলের ভাষা]

পুরােনাে ঢাকার খিস্তি খেউড় তুলে ধরা লেখকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেকে পাঠক তার উপন্যাসের সাবলীল ও খিস্তি খেউড়কে অশালীন বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু শিল্পিত বিষয়কে এভাবে তুলে ধরার সাহস বাংলা সাহিত্যে বিরল। তাই বলা যায়, ভাষা ও সংলাপের ব্যবহারে এ উপন্যাসটি অসাধারণ।

উপমা, প্রতীক ও চিত্রকল্প ব্যবহারের দক্ষতাঃ উপমা ব্যবহারে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাবলীলতা ধরা পড়ে এ উপন্যাসে। তবে শিল্পের প্রকরণগত ধারায় লেখক তার উপন্যাসটিকে সাজাননি। উপমা ব্যবহারেও লেখক জুম্মনের মায়ের প্রসঙ্গ তুলেছেন। যেমনঃ “গাঢ় লাল রক্ত ফোয়ারার মতাে উঠছে জুম্মনের মায়ের শরীর থেকে, সমস্ত ঘর কালচে লাল রঙ্গে অন্ধকার হলাে।'

চেতন, অবচেতন ও প্রাকচেতনের বিষয়টি ধরা পড়েছে ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসের ওসমানের মধ্য দিয়ে। লেখক ওসমানের চেতনার দ্বন্দ্বকে প্রতীকের মধ্য দিয়ে ঝাঁঝিয়ে তুলেছেন। যেমনঃ " “কালাে কালাে হাজার মাথা এগিয়ে আসছে স্রোতের মধ্যে ঘাই মারা রুই-কাতলার মতাে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ওপরে ওঠে আর নামে। উত্তেজিত রুই কাতলার ঝাঁক নিয়ে গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসছে কোটি ঢেউয়ের দল।” চিত্রকল্প ব্যবহারে তিনি বাস্তববাদী শেলীকে ব্যবহার করেছেন। কারণ লেখক বাস্তবে যা দেখেছেন, উপন্যাসে তারই সমন্বয় করেছেন। চিত্রকল্পের মধ্য দিয়েই লেখক বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমনঃ “এক পাল হাতি যেন দৌড়ে চলে যাচ্ছে বস্তির ওপর দিয়ে বাড়িঘর সব টপটপ পড়ে যায়।” এ্যাবসার্ডধর্মিতাও লক্ষণীয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে। ওসমানের উদ্ভট চিন্তা চেতনার ফলে অনেক জায়গায় ঘটনার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। এ্যাবসার্ড নাটকীয় ধারা তিনি তার এ উপন্যাসে এনেছেন। আনােয়ারকে লেখা ওসমানের চিঠিতে এ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমনঃ

“রাস্তায় রাস্তায় নদী, নদীর পানির ওপর ভর করে জ্বলতে থাকে আগুন। খবরের কাগজে পাও? কাগজে এর নাম দিয়েছে নদী ও আগুনের যুগল প্রবাহ।”

দ্বিরুক্ত শব্দ ব্যবহারেও লেখক উপন্যাসটিতে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের বিভিন্ন গুরুত্ববহ স্থানে দ্বিরুক্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- “কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজে করমালির ঘুম ভাঙ্গে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক ধারাগুলাের পরস্পর বিরােধিতা ‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে এসেছে। ঘরের বন্দিত্ব, চিত্তের শৃঙ্খল ভেঙে ওসমান কোথায় যেতে চায় তা উপন্যাসে সরাসরি বলা হয়নি। কিন্তু নতুন করে জেগে ওঠার আহ্বান করেছে, যা পাঠক পেয়ে যায় অনায়াসে এ উপন্যাসের বাঁকে বাঁকে। ওসমানকে লেখক সমর্পণ করেছেন কালের হাতে, আর হাড্ডি খিজির মরে গিয়েও শৃঙ্খল ভাঙার জন্য চিৎকার করে বারবার। ঘটনার সমান্তরাল দুই রেখার সমান্তরালে নির্মিত হয়েছে এ উপন্যাসের অখণ্ড জীবনবৃত্ত। ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং ফর্মসতর্কতার সমন্বয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলাদেশের উপন্যাসের এপিক ধারায় অন্যতম শিল্পী। তাই বলা যায়, এই উপন্যাসটি বিষয়বস্তু নির্বাচন-পরিবেশন, চরিত্র চিত্রণ, ঘটনাপ্রবাহ ও ভাষারীতিতে চিত্তাকর্ষক ও শিল্পসমৃদ্ধ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক