অথবা, সমালােচনাসহ বার্কলির “অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর" উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, 'Esse Est percipi' বার্কলির এই উক্তিটি বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ বিখ্যাত দার্শনিক জজ বিশপ বার্কলি বহুমুখী জড়বাদের বিরুদ্ধে জোরালাে ও আপসহীন যুক্তি দিয়ে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং স্বাধীন ও বৈপ্লবিক চিন্তার দিক থেকে আধুনিক দার্শনিক ডেকার্ট ও প্রধান দার্শনিক লাইবনিজের সমতুল্য। তিনি ১৮৬৫ সালে ১২ মার্চ আয়ারল্যান্ডের কিলকেন কাউন্টির অন্তর্গত জিসেন্টে জন্মগ্রহণ করেন। বার্কলির দর্শন তার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন লকের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। বার্কলির মতে, মন-নিরপেক্ষ বস্তু বলতে কিছু নেই। মন নিরপেক্ষ জড়-এর ধারণা নিতান্তই অবান্তর ও অর্থহীন। তিনি ছিলেন এক জন ভাববাদী দার্শনিক।
অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণ নির্ভরঃ বস্তুর প্রত্যয়ণের বিষয়ে বার্কলির অভিমত যে, যা প্রত্যক্ষযােগ্য নয় তার অস্তিত্ব নেই। যেসব দ্রব্যের প্রত্যক্ষণ সম্ভব নয়, সেসব দ্রব্যের অস্তিত্ব নেই। প্রত্যক্ষণযােগ্য গুণসমূহ মনের ধারণা বিশেষ। লকের গুণ ও অভিজ্ঞতাবাদ খণ্ডন করে বার্কলির যুক্তিগুলাে উপাস্থাপনের মাধ্যমে নিম্নে প্রমাণ করা হলাে যে, বস্তুর অস্তিত্ব তার প্রত্যক্ষণের ওপরই নির্ভর করে।
লকের অভিজ্ঞতাবাদঃ জন লক একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। তিনি দ্রব্য প্রত্যক্ষিত হয় এ কথা বলার পরেও স্বীকার করেছেন যে, রূপবান, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদি গুণাবলির ধারক হিসাবে জড়বস্তু অস্তিত্বশীল। তিনি আরও বলেছেন, বহির্জগত জ্ঞানের উৎস এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে মনের কোনাে ভূমিকা নেই, থাকতে পারে না।
বার্কলির খণ্ডনঃ জর্জ বার্কলি অভিজ্ঞতাবাদী জন লকের এ অভিমতকে খণ্ডন করে বলেছেন যে, সবকিছুই মননির্ভর। মনের বাইরে কোনাে কিছুর অস্তিত্ব নেই। মন নিরপেক্ষ জড়বস্তুর ধারণা নিতান্তই অবান্তর। মন নিরপেক্ষ কোনাে জড় বস্তু নেই, থাকতে পারে না। যা আছে তা সবই মনের ধারণা। বস্তুর অস্তিত্ব মনের ধারণার ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেছেন, মন নিরপেক্ষ কোনাে বস্তুর ধারণা অলীক কল্পনামাত্র। আমারা যাকে জড় বলে জানি তা আসলে জড় নয়। কতিপয় ইন্দ্রিয়লব্ধ গুণের সমাহার। আর এসব হলাে মানসিক অবস্থা। বার্কলির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, Esse Est Pericpi অর্থাৎ অস্তিত্বশীল হতে প্রত্যক্ষিত হওয়া আবশ্যক।
লকের গুণসমূহের মতবাদঃ বার্কলি দ্রব্যের দুই প্রকার গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মতে, দ্রব্য শুধু মুখ্য গুণের আধার নয়, বরং গৌণ গুণেরও ধারক। তিনি আরােও বলেন যে, সব গুণই মনের ধারণামাত্র। লক বস্তুর গুণাবলিকে মুখ্য ও গৌণ এ দুই ভাগে ভাগ করেছেন। তার মতে, বস্তুর আকার, আকৃতি, আয়তন, বিস্তৃতি হলাে মুখ্য গুণ। মুখ্য গুণ মননির্ভর বা আত্মগত নয়। অপরদিকে বস্তুর রূপ, রস, গন্ধ হলাে গৌণ গুণ এবং এগুলাে আংশিকভাবে মন নির্ভর। বার্কলি লকের গুণসংক্রান্ত এ মতবাদ খণ্ডন করে বলেছেন যে, বস্তুর মুখ্য ও গৌণ উভয় গুণই মন নির্ভর। কাজেই বস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা নেই। মন ও মনের ধারণাই অস্তিত্বশীল। এ থেকে বার্কলি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, কোনাে কিছুর অস্তিত্ব নির্ভর করে ঐ বস্তুটি প্রত্যক্ষিত হওয়ার ওপর। অর্থাৎ অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর বা Esse Est Percipi অস্তিত্ব প্রমাণ মুখ্য ও গৌণ গুণের পার্থক্য অস্বীকার অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর- এ উক্তিটি প্রমাণের জন্য বার্কলি লকের মুখ্য ও গৌণ গুণ সংক্রান্ত ধারণাকে খণ্ডন করেন এবং এদের মধ্যকার পার্থক্য অস্বীকার করেন। এ সম্পর্কে তার অভিমত যে, মূখ্য ও গৌণ গুণ উভয়ই মনের ধারণা। এ বিষয়ে তিনি নিম্নোক্ত যুক্তি প্রদান করেন-
(১) গুণমাত্রই প্রত্যক্ষলব্ধঃ মুখ্য গুণগুলাে গৌণ গুণগুলাের ন্যায় প্রত্যক্ষলব্ধ ।
(২) ব্যক্তিভেদে গুণের ভিন্নতাঃ গৌণ গুণগুলাের ন্যায় মুখ্য গুণগুলাে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন একই ফল বিভিন্ন লােকের কাছে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কারাে কাছে মিষ্টি লাগে তাে কারাে কাছে টক।
(৩) পৃথকভাবে প্রত্যক্ষিত নয়ঃ মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণগুলােকে পৃথকভাবে প্রত্যক্ষণ করা যায় না। যেমন- কোনাে বস্তুর রূপ আছে। কিন্তু আকার নেই এমন কিছু প্রত্যক্ষণ করা যায় না। সুতরাং গৌণ গুণগুলাে মনের ধারণা হলে মুখ্য গুণসমূহও মনের ধারণা হবে। এভাবে বার্কলি প্রমাণ করেন যে, মুখ্য ও গৌণ উভয়গুণই মনের ধারণামাত্র। মুখ্য গুণগুলাে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করি, যা কিছু প্রত্যক্ষণ করা যায়, তাই মনের ধারণা। সুতরাং এ মুখ্য গুণগুলাে গৌণ গুণগুলাের ন্যায়ই মনের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ চেতনা বহির্ভুত এদের কোনাে অস্তিত্ব নেই।
(৪) অস্তিত্বের প্রমাণঃ বার্কলির মতে, প্রত্যক্ষগােচর বস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। যদি উনুনে ভাতের হাড়ি বসিয়ে দিয়ে ফিরে এসে দেখি যে ভাত ফুটছে। তাহলে বার্কলি মত অনুযায়ী, আমি যতক্ষণ প্রত্যক্ষণ করিনি এবং সে সময় অন্য কেউ প্রত্যক্ষণ না করে থাকে তখন উনুন ও হাড়ি এসবের কোনাে অস্বিত্ব ছিল না। আবার ঘরে ঢােকার সাথে সাথে এগুলাে অস্তিত্বশীল হচ্ছে। তাহলে ভাত ফুটল কী করে? বস্তুর ধারাবাহিকতা কীভাবে প্রমাণ করা যায়? এ কারণে বার্কলি তার দর্শনে পরিশেষে ঈশ্বরের ধারণা এনেছেন। তার মতে, ঐ বস্তুগুলাে আমরা দেখি আর না দেখি ঈশ্বর দেখেন, তাই এগুলাে অস্তিত্বশীল।
(৫) বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণে ওপর নির্ভরশীলঃ বার্কলির মতে, “বস্তুর অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভরশীল” অর্থাৎ আমরা যখন কোনাে বস্তু প্রত্যক্ষণ করি না তখন সে বস্তু ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের বিষয় হয়ে থাকতে পারে। সুতরাং বার্কলির মতে, সমস্ত জগতটাই ঈশ্বরের ধারণারূপে রয়েছে এবং আমাদের প্রত্যক্ষ হলাে ঈশ্বরের মনের ধারণাকেই একটি সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির থেকে প্রত্যক্ষ করা।
সমালােচনাঃ বাকর্লির এ প্রত্যক্ষণের মতবাদ দর্শনের ইতিহাসে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করলেও এটা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। নিম্নে এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত উল্লেখযােগ্য ত্রুটিগুলাে বর্ণনা করা হলাে-
(১) দার্শনিক আলেকজান্ডারের মতে, কোনাে কিছু জ্ঞানের বিষয় হওয়ার জন্য মনের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু অস্তিত্বের জন্য মনের ওপর নির্ভর করে না।
(২) জন লক সমালােচনা করে বলেছেন, বস্তু তার ধারণার অনুরূপ বলে বার্কলি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, বস্তু ও ধারণা অভিন্ন। এটা মােটেও গ্রহণযােগ্য নয়।
(৩) দার্শনিক G.E. Moore বার্কলির “অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর” এ উক্তির সমালােচনা বলেছেন যে, বস্তু আছে বলে তা প্রত্যক্ষের বিষয় হতে পারে। বস্তুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে না। সুতরাং বার্কলির মতটি গ্রহণযােগ্য নয়।
(৪) দার্শনিক R.B. Perry-এর মতে, “বার্কলি আত্মকেন্দ্রিক সংকটাবস্থা অনুমানের মাধ্যমে তার ভাববাদের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার এ অনুমান ভ্রান্ত।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বার্কলির মতবাদের সমালােচনা থাকা সত্ত্বেও তার মতবাদের দার্শনিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তার দর্শন ছিল অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে পরিচালিত অকপট ও নিবেদিত চিন্তার ফসল। বাকর্লি মনে করেন, অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর। প্রত্যক্ষণের ফলেই বস্তু অস্তিত্বশীল হয়ে থাকে। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বার্কলি তার এ মৌলিক মতবাদের জন্য দর্শনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
0 মন্তব্যসমূহ