‘চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে খয়বার গাজী কে?


প্রশ্নঃ খয়বার গাজী কে? তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ ‘চিলেকোঠার সেপাই' আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা অসাধারণ উপন্যাস। তার এই সার্থক উপন্যাস সৃষ্টির পিছনে সবচেয়ে বড়াে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তার চরিত্র চিত্রণের অসাধারণ দক্ষতা। তিনি তার নিপুণ হাতে চরিত্রগুলাে সৃষ্টি করে ব্যতিক্রমী শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেছেন। এ উপন্যাসের একটি অন্যতম নেতিবাচক চরিত্র খয়বার গাজী।

উপন্যাসের তথ্য থেকে জানা যায়- ইউনিয়ন বাের্ডের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বর্তমান ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার খয়বার গাজী। সে সম্রান্ত বংশের সন্তান, কিন্তু সে নিজে দুষ্ট প্রকৃতির। সে শত শত বিঘা জমির মালিক, যমুনায় চর জাগলে সেটার মালিকও সে। সে যে কত মানুষের সর্বনাশ করেছে তা লেখাজোখা নেই। সে এ অঞ্চলের সবার গরু চুরি করে তার চরের খােয়াড়ে রাখে- সেখান থেকে গরু ছাড়িয়ে আনতে যে টাকা লাগে সে তা ভােগ করে। সে শক্তিমান, দারােগা গরু চুরির এজাহার নেয় না। সে যার পেছনে একবার লাগে তার সর্বনাশ করে ছাড়ে। তার সাথে কেউ বিবাদ করলে তার ফল ভালাে হয় না। তার বহু মামলা, সে মূলত মামলাবাজ লােক। সে যেমন নৃশংস তেমনি ভয়ানক ও বিপজ্জনক। সে পাকিস্তানের সমর্থক। সে নিজে হাতে কিছু করে না, লােকজন দিয়ে শক্রকে হত্যা করে। সে খুনির সর্দার। সে বকধার্মিক, নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ হয়ে গেছে কিন্তু মিথ্যা কথা ছাড়েননি। তবে খয়বারের গুণ হচ্ছে- আত্মীয়স্বজন কারাে অসুখবিসুখ হলে খয়বার জান দিয়ে খাটে, ডাক্তার ডাকে, ওষুধ আনে- নিজ হাতে ওষুধ খাওয়ায়। সর্বোপরি খয়বার খান্দানি শয়তান।

শহরে যেমন হাডিড খিজিররা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, গ্রামে গ্রামে সেভাবেই ঝাপিয়ে পড়েছে চেংটু, করমালি, আলীবক্স। তাদের কর্মসূচি আরাে অগ্রসর। তারা অনেক দূরের আইয়ুব খান, পাকিস্তান বাহিনীর পিণ্ডির শােষণ যেমন দেখেতে পায়, চোখের সামনে খয়বার গাজী, আফসার গাজীদের ভূমিকা আরাে স্পষ্টভাবেই চিনতে শেখে। জানতে পারে, খয়বার গাজীরা সেসব মানুষ যারা আইয়ুব খানের আঞ্চলিক প্রতিনিধি। আইয়ুব খানরা যদি দিগন্ত বিস্তারকারী বিশালদেহী জোঁক হয়, খয়বর গাজীদের মতাে লােকেরা সেই জোঁকের মুখ। সে মুখে লবণ দেওয়ার কাজটাও তারা করতে চায়। কিন্তু তাতে সমর্থন নেই আইয়ুববিরােধী ছয় দফার প্রবক্তা নেতাদের। কারণ তারাও আইয়ুব খানদের শ্রেণি উত্তরসূরি। কী করে খয়বর গাজীরা? তারা মানুষের নামে অহেতুক মামলা ঠোকে। ভিটেমাটি কেড়ে নেয়, কেউ প্রতিবাদ করলে তার লাশ, পাওয়া যায় মাঠে-নদীতে। এমনকি হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে নিজের অবাধ্য কিষাণকে পর্যন্ত খুঁটির সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারতে পারে।

আদালতের মামলায় কোনােদিন খয়বার গাজীরা শাস্তি পায় না, মামলায় হারে না। কারণ সরকারের আদালত তাে তাদেরই আদালত। তাই আলী বক্স, করমআলীরা গাজীরা গণআদালত বসাতে চায়। সেখানে বিচার করতে চায় খয়বার গাজীদের মতাে মানুষদের। এইবার মুছিবত খয়বার গাজীদের। ডাকাত-চরের বাথান তার লুট হয়। তার প্রধান অনুচর হােসেন আলী নিহত হয় বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে। এখন গণআদালতে বিচার হবে তার। গ্রামের সংগঠিত মানুষ প্রত্যয় ঘােষণা করেছে, “এইবার মুরুব্বি মানুষের হাতে মরতে কেমন লাগে। বেটা এখান থেকে কলকাঠি নাড়াে, মানুষের গরু চুরি করে তার কাছ থেকেই জরিমানা আদায় করাে। কারাে জমিতে তারা বর্গা দিতে না পারে তার ফন্দি আটো? সবাই এসে তােমার পায়ে পড়ুক, তুমি ইচ্ছামতাে মানুষের ভিটাটুকু পর্যন্ত কবজা করে তাকে তােমার গােলাম বানাও। এইবার? এইবার ভেতর থেকে ভাঙ্গতে শুরু করেছে। উপরটা আপনা আপনিই ধ্বসে পড়তে কতক্ষণ?”

খয়বার গাজী কৃষকদের গরু চুরি করে চরে নিয়ে আটকে রেখে কৃষকদের বহু ক্ষতি করেছে। গণবিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হয়, কিন্তু সুকৌশলে সে বেঁচে যায়। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হওয়া সে সময়েরই সমাজ বাস্তবতা- এ বাস্তবতার নিরিখে। খয়বার গাজী চরিত্রটি সর্বৈব সফল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক