উপস্থাপনাঃ উত্থান-পতন আর ভাঙা-গড়ার ইতিহাস চিরন্তন। মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও এ ঐতিহাসিক বাস্তবতার ব্যতিক্রম হয়নি। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে সমাট বাবর কর্তৃক ভারতে প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্য ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, কিন্তু আওরঙ্গজেবের পরবর্তী দুর্বল উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা ও অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক কারণে তার পতন ঘটে।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণঃ ঐতিহাসিকগণ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- ক, অভ্যন্তরীণ কারণ ও খ. বাহ্যিক কারণ।
ক. অভ্যন্তরীণ কারণঃ
১. ইতিহাসের বাস্তবতাঃ উত্থান-পতন আর ভাঙ্গা-গড়া ইতিহাসের চিরন্তন বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতার পথ ধরেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ইবনে বতুতা বলেন- Decline and downfall of the dynasty is historical phenomenon of the history.
২. সাম্রাজ্যের বিশালতাঃ ঐতিহাসিক ভি. এ. স্মিথ বলেন, মুঘল সাম্রাজ্যের বিশালতা এর পতনের অন্যতম কারণ। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য আফগানিস্তান থেকে আসাম এবং কাশ্মীর থেকে মহীশূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল, যা পরবর্তী দুর্বল শাসকদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
৩. সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাবঃ সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী নির্বাচন নীতির অভাবে সিংহাসনকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব কলহ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ।
৪. অভিজাতবর্গের নৈতিক অবনতিঃ অভিজাত শ্রেণির নৈতিক অধঃপতন মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ। কারণ তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইরানি, তুরানি, হিন্দুস্তানি প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
৫. জনসমর্থনের অভাবঃ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের প্রতি জনসাধারণের সমর্থনের অভাব। প্রজাদের গণতান্ত্রিক সমর্থনের অভাবে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
৬. সামরিক শক্তির দুর্বলতাঃ বিশাল সাম্রাজ্য রক্ষায় মুঘলদের পক্ষে শক্তিশালী ও বিশাল সামরিক বাহিনী গঠন সম্ভব হয়নি। এ ব্যর্থতা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৭. উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থার অভাবঃ মুঘলদের সময়ে দেশে উন্নত যােগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে কেন্দ্র থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাথে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রাখা সম্ভব হতাে না।
৮. প্রাদেশিক শাসকদের বিদ্রোহঃ মুঘল শাসনের শেষ দিকে সম্রাটদের দুর্বলতার সুযােগে একের পর এক প্রাদেশিক শাসকগণ স্বাধীনতা ঘােষণা করতে থাকেন।
৯. অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতিঃ মুঘল সাম্রাজ্যের পতন যুগে সম্রাটদের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হতাে। এটাও মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করে।
১০. কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতাঃ মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট বাবর ও আওরঙ্গজেব ব্যতীত সবাই ছিলেন দুর্বলচেতা। তাদের দুর্বলতার কারণে সাম্রাজ্যের ভিত্তি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
১১. প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহঃ কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযােগে অনেক প্রাদেশিক শাসনকর্তাই বিদ্রোহ ঘােষণা করে। তাদের বিদ্রোহ সাম্রাজ্যের সংহতির ওপর মারাত্মক আঘাত হানে।
১২. হিন্দুদের পুনর্জাগরণঃ মুঘল শাসনের শেষ দিকে মারাঠা, শিখ ও রাজপুত তথা গােটা হিন্দু জাতির পুনর্জাগরণ মুঘলদের শক্তি সংহতি বিনষ্ট করে দেয়।
১৩. সম্রাটদের নৈতিক অবনতিঃ আওরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাটগণ ভােগ বিলাসিতা ও চারিত্রিক অবনতি এবং আরাম আয়েশের মধ্যেই দিনাতিপাত করতেন।
১৪. নৌবাহিনীর অভাবঃ বহুদূর বিস্তৃত উপকূল রক্ষা করার জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের প্রয়ােজনীয় নৌশক্তির অভাব ছিল। ফলে নৌশক্তির বলে বলীয়ান ইউরােপীয় বণিকগণ ভারতবর্ষের রাজনীতিতে প্রবেশ করার সুযােগ পায় এবং কালক্রমে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়।
১৫. শিয়াদের বিরােধিতাঃ সম্রাট আওরঙ্গজেব শিয়াদের নওরােজ উৎসব ও মহররমের অত্যধিক বাড়াবাড়িমূলক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেন। ফলে শিয়াদের অসন্তোষ। মুঘল শক্তিকে ক্ষীণ করে তােলে।
১৬. দাক্ষিণাত্য নীতিঃ আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির কারণে কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৭. বৈদেশিক আক্রমণঃ মুঘল সাম্রাজ্য যখন ধ্বংসের পথে তখন নাদির শাহ ও আহমদ শাহ আবদালীর আক্রমণে তা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে।
১৮. জনকল্যাণমূলক নীতির অভাবঃ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তাদের জনকল্যাণমূলক নীতির অভাব। কারণ মুঘল শাসকদের অনেকেই দেশ শাসনে স্বৈরাচারী নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
১৯. স্বাভাবিক স্থিতিকালঃ ইবনে খালদুন বলেন, “কোনাে রাজ বংশের স্বাভাবিক স্থিতিকাল ১০০ বছর। এ স্থিতিকাল অতিবাহিত হওয়ার পরই এর পতনের পালা শুরু হয়। সুতরাং মুঘল বংশেরও স্বাভাবিক স্থিতিকাল অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় এর পতন ঘটে।” .
খ. বাহ্যিক কারণঃ
১. নাদির শাহের আক্রমণঃ মুঘল সাম্রাজ্য অভ্যন্তরীণ শক্তি, প্রতিরােধ ক্ষমতা এবং নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সকল শক্তি হারিয়ে যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছিল, ঠিক সে সময় পারস্য সম্রাট নাদির শাহের আক্রমণ, লুণ্ঠন ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড মুঘল সাম্রাজ্য তছনছ করে দেয়।
২. আহমদ শাহ আবদালীর আক্রমণঃ নাদির শাহের সহজ সাফল্যজনক বিজয় পরবর্তীকালে আফগান নেতা আহমদ শাহ আবদালীকে প্রলুব্ধ করে। তিনি কমপক্ষে নয় বার ভারত আক্রমণ করে অধঃপতিত মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংস সুনিশ্চিত করেন।
৩. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থানঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমশ ভারত উপমহাদেশে শক্তিশালী হয়ে কালক্রমে জোরপূর্বক মুঘল সিংহাসন অধিকার করে নেয়।
৪. ব্রিটিশ বেনিয়াদের উত্থানঃ ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর ছলে-বলে-কৌশলে ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারতবর্ষে পর্যায়ক্রমে আধিপত্য বিস্তার এবং দিল্লীর সিংহাসন দখল করে মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ চিহ্নটুকুও নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
উপসংহারঃ উপরিউক্ত কারণগুলাের প্রেক্ষিতে নিয়তির অমােঘ বিধান সর্বোপরি ইবনে খালদুনের অভিমত অনুসারে, প্রাকৃতিক নিয়মেই মুঘল সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে পতনের দিকে ধাবিত হয়। যার সর্বশেষ পরিণতি ঘটে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে।
0 মন্তব্যসমূহ