অথবা, ফাদার উইলহেলম স্কামিডটের ব্যাপ্তিবাদী মতবাদ সমালােচনাসহ ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ ব্যাপ্তিবাদ সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনাে সংস্কৃতিই স্বনির্ভর নয়। কোনাে না কোনাে কারণে এক সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল। কোনাে সংস্কৃতিতে একবার আবিষ্কৃত কোনাে বিষয় অন্য সংস্কৃতিতে নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয়নি। এক সংস্কৃতি অনেকটা অনুকরণের মতােই অন্য সংস্কৃতির উপকরণ সংগ্রহ করে। আর এভাবেই মূলত সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে।
ব্যাপ্তিবাদ (Diffusionism): ব্যাপ্তিবাদের মূলকথা হচ্ছে সমাজ ও সংস্কৃতির উপাদানগুলাে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় পৃথকভাবে সৃষ্টি হয়নি; বরং এক সমাজ অন্য কোনাে বিশেষ সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে উপাদানগুলাে গ্রহণ করে থাকে। আর এভাবেই ঘটে সংস্কৃতির প্রসার। সংস্কৃতির প্রসার সম্পর্কে এ ধারণার নাম ব্যাপ্তিবাদ। সাধারণত উন্নত সমাজের বিভিন্ন উপাদান যেমন- ভাষা, পােশাক, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র ইত্যাদি অন্য সমাজে প্রভাব বিস্তার করে এবং অন্য সমাজ দ্বারা গৃহীত হয়।
ফাদার উইলহেলম স্কামিডট-এর ব্যাপ্তিবাদী মতবাদঃ সংস্কৃতির বিস্তার সম্পর্কে যেসকল মতবাদ রয়েছে, সেগুলাের মধ্যে ব্যাপ্তিবাদ প্রধান। আর ব্যাপ্তিবাদ সম্পর্কে যেসকল মতবাদ রয়েছে, সেগুলাের মধ্যে ফাদার উইলহেলম স্কামিডট-এর ব্যাপ্তিবাদী মতবাদটি অন্যতম। ফাদার স্কামিডট ১৮৬৮ সালে অস্ট্রেলিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পড়াশােনা শেষে ফাদার কোপারের সাথে বর্তমানে নামকৃত “Vienna School of Diffusionism" প্রতিষ্ঠা করেন। তার সৃষ্টকর্মে Rotzel-এর প্রভাব বেশ লক্ষ্য করা যায়। শুরুতে তিনি বিবর্তনবাদী মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরবর্তীতে বিবর্তনবাদের প্রকৃত ধারণা থেকে ভিন্নমত পােষণ করেন।
ফাদার স্কামিডট (Schamidt) এবং গ্রায়েবনার (Graebner) উভয়েই সাংস্কৃতিক বিকাশ নিয়ে তীব্র কৌতুহলী ছিলেন। তবে অনেকক্ষেত্রেই তাদের ভিন্ন মত ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গ্রায়েবনার (Graebner) এর মতে, তাসমানিয়ার সংস্কৃতি হলাে প্রাচীনতম সংস্কৃতি চক্র অথচ ফাদার স্কামিডট (Schamidt) তা সমর্থন করেন নি। বরং সাংস্কৃতিক চক্র আলােচনার ক্ষেত্রে (Schamidt) একেবারে মুক্তচিন্তার অধিকারী ছিলেন। আসলে তিনি পর্বসরিদের মতবাদ থেকে দূরে সরে এসেছিলেন। তার ধারণা অনুযায়ী তাসমানিয়া নয় বরং আফ্রিকার পিগমিদের সংস্কতিই সবচেয়ে প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক চক্র। তিনি বিশদভাবে পিগমিদের সম্পর্কে বর্ণনা দেন। তার মতে, পিগমিরা ছিল আফ্রিকার আদি অধিবাসী এবং অন্যান্য গােষ্ঠী তাদের পরে প্রবেশ করে। ফাদার স্কামিডট পিগমিদের সাংস্কৃতিক চক্রকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করেন। যথা- (১) আদিম (Primitive) (২) প্রাথমিক (Primary) (৩) দ্বিতীয় পর্যায় (Secondary) (৪) তৃতীয় পর্যায় (Tertiary)
স্কামিডট মূলত ভাষার ওপর ভিত্তি করে সংস্কৃতি চক্রটি প্রদান করেন। পরে তিনি মন্তব্য করেন সংস্কৃতি ও ভাষাতাত্তিক আলােচনা প্রায় একই ধরনের। ফাদার উইলহেম স্কামিডটের বিশ্বাস হচ্ছে বর্তমানকালে পিগমিরা মানবজাতির আদিযুগের প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি পিগমিদের ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কেও বিশদ বিবরণ প্রদান করেন। ১৯২৬ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ১২ খণ্ডে প্রকাশিত তার বৃহত্তম গ্রন্থ 'The Origin of the Idea of God' গ্রন্থে এর বিবরণ তুলে ধরেন। ধর্ম সম্পর্কে তার মতবাদ নৃ-বিজ্ঞানী E.B. Taylor-এর সাথে অনেকাংশে সম্পর্কিত এবং এতে নতুন মাত্রা যােগ করে। এখানে তিনি শুধু ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে আগের মতবাদগুলােই বর্ণনা করেননি বরং নতুন, অনেক আলােচনা এতে সংযুক্ত করেন। তার মতে, ধর্মের আদিরূপে মানুষ সর্বপিতার মতাে উচ্চ দেবতার পূজা করতাে। ফলে তাদের মধ্যে একেশ্বরবাদের কোনাে প্রমাণ নেই। ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে তার মতবাদ সুদূরপ্রসারী হলেও তা Taylor এবং Frazer এর মতাে অনেকটা কল্পনামূলক থেকে যায় এবং তা ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে যথেষ্ট অর্থবহ হয় নি।
অন্যান্য মতবাদ প্রদানকারীরা যে কেবল তার ব্যাপ্তিবাদের বিরােধিতা করেছেন তা নয় বরং ব্যাপ্তিবাদ মতবাদে বিশ্বাসীরাও এ মতবাদের বিরােধিতা করেছেন। (Schamidt) বলেছেন, সংস্কৃতির আদিরূপ হচ্ছে তাসমানিয়া সংস্কৃতি। আবার গ্রাফটন ইলিয়ট স্মিথের মতে, সংস্কৃতির আদিরূপে ছিল মিশরীয় সংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতি থেকেই সারাবিশ্বে সংস্কৃতির বিস্তার লাভ ঘটে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সংস্কৃতির প্রসার যে কেবল সংস্কৃতি সৃষ্টির মাধ্যমে হচ্ছে নয় বরং সংস্কৃতির প্রসার হচ্ছে এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে ব্যাপ্তির মাধ্যমে। তবে সংস্কৃতির মূলে যেকোনাে সংস্কৃতি রয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে সংস্কৃতির আদিরূপে পিগমিদের অবস্থান অনেকটা তথ্যবহুল। আর এ কারণেই সংস্কৃতির প্রসারে (Schamidt)-এর মতবাদ বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
0 মন্তব্যসমূহ