সম্রাট শাহজাহানের চরিত্র ও কৃতিত্ব বিশ্লেষণ কর


প্রশ্নঃ সম্রাট শাহজাহানের চরিত্র ও কৃতিত্ব বিশ্লেষণ কর।

উপস্থাপনাঃ জীবনের ভাগ্যবিড়ম্বনায় মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ জাঁকজকমপ্রিয় সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল নানাবিধ ঐতিহাসিক কারণে বিশেষভাবে স্মরণীয়। তার ত্রিশ বছরের রাজত্বকালকে মুঘল শাসনের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তাই তার চরিত্র ও কৃতিত্ব বর্ণনায় ঐতিহাসিক ট্যাভারনিয়ার বলেন- Shahjahan ruled over his people rather as a father over his family than as a king over his subject.

সম্রাট শাহজাহানের চরিত্রঃ
১. তাকওয়াবান শাসকঃ তাকওয়া এবং বস্তুজগতের প্রতি অনাসক্তি সম্রাট শাহজাহানের অন্যতম চরিত্র বলে অনেক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন।

২. ন্যায়পরায়ণ শাসকঃ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সম্রাট শাহজাহান একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তিনি মমতাজ মহলের সমাধির ওপর তাজমহল তৈরি করে তার ন্যায়পরায়ণতা ও স্ত্রীপ্রেমের প্রমাণ পেশ করেছেন।

৩. শিক্ষানুরাগীঃ শাহজাহান ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন বিদ্বান ও বিদ্যানুরাগী। আরবি, ফারসি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় তার দখল ছিল পর্যাপ্ত। শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তার সময়ে সাহিত্যচর্চার যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছিল।

৪. সুদক্ষ শাসকঃ পত্মীপ্রেমিক সম্রাট শাহজাহান ছিলেন একজন সুদক্ষ শাসক। আইন অমান্যকারী ঘনিষ্ঠ হলেও তাকে ক্ষমা করতেন। এজন্য ঐতিহাসিকগণ তার কর্মদক্ষতা ও সুশাসনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

৫. সন্তান ও পত্নীপ্রেমীঃ সম্রাট ছিলেন তার সন্তানদের প্রতি স্নেহশীল পিতা, আর প্রিয়তমা স্ত্রীদের প্রতি গভীর অনুরাগী। তার পত্নীপ্রেম এক অনুপম আদর্শ।

৬. উদারতাঃ উদারতা ছিল সম্রাট শাহজাহানের চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। তিনি উদারতা ও মহত্ত্ব দিয়ে সাম্রাজ্যের সাধারণ জনতার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।

৭. প্রজাহিতৈষীঃ প্রেমের মূর্ত প্রতীক সম্রাট শাহজাহান ছিলেন একজন প্রজাহিতৈষী শাসক। তিনি প্রজাদের অভিযােগের সুযােগ দিতেন এবং তাদের কল্যাণে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

৮. চরিত্রের সমালােচনাঃ ঐতিহাসিক বার্নিয়ার, টেভারনিয়ার, টোরি, টমাস রাে, মানুচি প্রমুখ সম্রাট শাহজাহানকে বিলাসপ্রিয়, ব্যভিচারী, অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর বলে আখ্যায়িত করেছেন। ড. স্মিথও শাহজাহান সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। তবে তার ব্যাপারে ঢালাও মন্তব্য গ্রহণযােগ্য হতে পারে না।

শাহজাহানের কৃতিত্বঃ
১. সামরিক সাফল্যঃ মুঘল সম্রাট আকবর কর্তৃক দাক্ষিণাত্যে যে সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসৃত হয়েছিল, সমরকুশলী সম্রাট শাহজাহান সে নীতি অনুসরণ করে বিজাপুর, আহমদনগর, গােলকুণ্ডা ও বিদরে মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি পর্তুগীজ জলদস্যুদেরও বিতাড়িত করেন।

২. উন্নত প্রশাসন ব্যবস্থাঃ সম্রাট শাহজাহান সমগ্র সাম্রাজ্যে এক উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সকল পর্যায়ে শান্তি-শৃঙখলার নিশ্চয়তা বিধান করেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিক তার উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

৩. কৃষিকার্যের উন্নতি সাধনঃ সম্রাট শাহজাহান কৃষিকার্যের উন্নতি সাধনে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং জাতির মেরুদণ্ড কৃষককুলকে নানাবিধ সুযােগ-সুবিধা প্রদান করেন। ফলে তার সময়ে কৃষিব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি সাধন হয়।

৪. ব্যবসায় বাণিজ্যের সম্প্রসারণঃ সম্রাট শাহজাহান শিল্প বাণিজ্যের প্রসার ঘটানাের জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। তার সময়ে স্থল ও নৌবাণিজ্যের যথেষ্ট উন্নতি সাধন হয়। তিনি সারাদেশে ব্যবসায় নেটওয়ার্ক গড়ে তােলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যাপক সম্প্রসারণ করেন।

৫. শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকঃ ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন, শাহজাহান শিক্ষা ও সাহিত্যের উদার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তার শাসনামলে সাহিত্যচর্চা উৎকর্ষ লাভ করে। আবদুল হামিদ লাহােরীর বাদশাহনামা, ইনায়েত খানের শাহজাহাননামা গ্রন্থদ্বয় তার সময়ে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল।

৬. মিলন কেন্দ্রঃ সম্রাট শাহজাহানের দরবার ছিল কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের মিলনকেন্দ্র। তিনি নিজেও একজন হস্তলিপি বিশারদ ছিলেন। তার শাসনামলে অনেকগুলাে সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়।

৭. সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাঃ সম্রাট শাহজাহান বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সুশাসন, ন্যায়বিচার ও বদান্যতার জন্য তার শাসনকাল ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

৮. বিচার ব্যবস্থাঃ ঐতিহাসিক জে. এন. সরকার বলেন, শাহজাহানের শাসনামলে বিচার ব্যবস্থা ছিল নিরপেক্ষ। কাযী ও মীরে আদল কর্তৃক বিচারকার্য সম্পাদিত হতাে। সম্রাট নিজেই প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করতেন।

৯. কল্যাণময় সাম্রাজ্যের রূপকারঃ মুঘল সাম্রাজ্যকে কল্যাণময় ও জনপ্রিয় করে গড়ে তােলার ক্ষেত্রে শাহজাহানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তার দীর্ঘ শাসনামলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিক মুঘল প্রশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে।

১০. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনঃ শিক্ষার প্রসারকল্পে শাহজাহান সামাজ্যের সর্বত্র বহু বিদ্যালয়, বিখ্যাত দারুল বাকা মাদরাসা এবং দিল্লীর রাজকীয় কলেজ স্থাপন করেন।

১১. স্থাপত্যশিল্পের উৎকর্ষ সাধনঃ স্থাপত্যের রাজপুত হিসেবে খ্যাত সম্রাট শাহজাহান স্থাপত্যশিল্পের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তার স্থাপত্যকীর্তিসমূহের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত হলাে যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত আগ্রার তাজমহল। শাহজাহান প্রিয়তমা পত্নী মমতাজ মহলের সমাধির ওপর এ তাজমহল গড়ে তােলেন। প্রতি বছর বহু সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষ এর সৌন্দর্য দর্শনে তৃপ্ত হয়। আর স্মরণ করে শাহজাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পপ্রেমিক ও প্রেমময় হৃদয়টিকে। কবি নজরুলের ভাষায়-
তাজমহলের পাথর দেখেছাে
দেখেছাে কি তার প্রাণ
অন্তরে তার মমতাজ নারী
বাহিরে শাহজাহান।
১২. অন্যান্যঃ সম্রাট শাহজাহানের অন্যান্য স্থাপত্যকীর্তিগুলাের মধ্যে ময়ূর সিংহাসন, মতি মসজিদ, দিল্লীর জামে মসজিদ, দিল্লীর দুর্গ, শীশমহল, মুসাম্মাম বুরুজ, কোহিনূর, লাহােরের শালিমার বাগ, লালকেল্লা, শাহজাহানাবাদ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।

উপসংহারঃ সম্রাট শাহজাহানের চরিত্র ও কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক এলফিন। স্টোন তাকে ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা মহিমান্বিত সম্রাট বলে অভিহিত করেন। অপরদিকে ড. স্মিথ বলেন- Shahjahan's reign marks the climax of Mughal dynasty and empire.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক