অথবা, রিদ্দার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা কর।
অথবা, স্বধর্ম ত্যাগ আন্দোলন সম্পর্কে যা জান লেখ।
উপস্থাপনাঃ মুহাম্মদ (স)-এর শূন্যতায় যখন সমগ্র আরব হাহাকার করছিল। বিশ্ব স্রষ্টার একমাত্র দ্বীন ইসলামের ভিত নড়ে উঠেছিল। তখন রাসূলের যােগ্য উত্তরসূরি আবু বকর (রা) সংকটাপন্ন আরবে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে রিদ্দার যুদ্ধের সফল অভিযান পরিচালনা করেন। দু’বছর তিন মাস শাসনামলের অধিকাংশ সময় তাকে রিদ্দা যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছিল। তাই ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন- The short Chilaphate of Abu Bakar was mostly occupied with the so called Ridda wars.
রিদ্দা যুদ্ধের পরিচয়ঃ রিদ্দ আরবি শব্দ, যার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা। মহানবী (স)-এর মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে দুর্বল চিত্তের কিছু ঈমানদার ইসলাম ত্যাগ করে পূর্ব ধর্মে প্রত্যাবর্তন শুরু করে। এদের দমন করার উদ্দেশ্যে সে জেহাদ পরিচালিত হয়, ইসলামের ইতিহাসে তাই রিদ্দার যুদ্ধ বা স্বধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামে পরিচিত।
রিদ্দার যুদ্ধের কারণসমূহঃ
১. ইহুদিদের যড়যন্ত্রঃ ‘মাকাইদুল ইয়াহুদিয়াহ' নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, মহানবী (স) মদিনায় আগমনের কারণে মদিনায় বসবাসকারী ইহুদিদের নেতৃত্ব লাভের দীর্ঘ দিনের আশা অপূর্ণ রয়ে যায়। ফলে রাসূল (স)-এর মৃত্যুর সাথে সাথে তারা যড়যন্ত্র করতে থাকে।
২. ইসলাম প্রচারে বিঘ্নঃ মহানবী (স)-এর জীবদ্দশায় আরব উপদ্বীপের মােট এক-তৃতীয়াংশ লােকও ইসলাম গ্রহণ করেনি। দীর্ঘকাল যুদ্ধবিগ্রহে রত থাকা, সুষ্ঠু যােগাযােগের অভাব, সময়ের স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণে সমগ্র আরব জাতিকে ইসলামের ছায়াতলে আনা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
৩. ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাতঃ আরববাসীদের মধ্যে গােত্রপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বাতন্ত্র্যবােধ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নেতৃত্বের লোভ ছিল। কিন্তু ইসলাম প্রতিষ্ঠার ফলে এসব বিলীন হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠিত হয় ভ্রাতৃত্ববােধ, সাম্য-মৈত্রীর সুমহান আদর্শ। যা বেদুইনদের মনে দারুণ আঘাত হানে। তারা যেহেতু গোত্রের দলপতিকে অন্ধের মতাে অনুসরণ করত, তাই গােত্রপতির ধর্মত্যাগের সাথে সাথে তারাও ধর্মত্যাগী হয়ে বিদ্রোহ করে।
৪. নবুয়তপ্রাপ্তীর আকাঙ্ক্ষাঃ নবুয়তের পদ ছিল অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। তাই কতিপয় লােক সম্মান ও পদ মর্যাদার লােভে মিথ্যা নবুয়তী দাবি করে। আর মিথ্যা প্রলােভন দেখিয়ে আরবদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তােলে।
৫. মদিনায় মুসলিম প্রাধান্যে ঈর্ষাঃ ঐতিহাসিক মুইর বলেন, মদিনা ছিল ইসলামের প্রধান কেন্দ্র, কিন্তু আরব গােত্রসমূহ কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে থেকে মদিনার প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
৬. বিপ্লববিরােধী মনােভাবঃ মহানবী (স) আরবের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। এ ধরনের পরিবর্তনে বেদুইনরা খুশি হতে পারেনি এবং আরব গােত্রসমূহ নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। ফলে রাসূল (স)-এর মৃত্যুর পর স্বার্থপর বেদুইনরা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে।।
৭. যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতিঃ ঐতিহাসিক পি. কে হিট্টি বলেন, ইসলামের যাকাত ব্যবস্থাকে রিদ্দার যুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বেশ কিছু গােত্র হযরত আবু বকর (রা)-এর শাসনামলে যাকাত না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা মদিনার চারদিকে এসে ছাউনি ফেলে।
৮. ভণ্ডনবীদের উত্থানঃ রাসূল (স)-এর মৃত্যুর পর নবুয়তকে লাভজনক ব্যবসা মনে করে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী কতিপয় ভণ্ড নবীর উদ্ভব হয়। এ সকল ভণ্ডনবীদের মধ্যে আসওয়াদ আনাসি, মুসায়লামা, তােলায়হা ও সাযাহ ছিল উল্লেখযােগ্য। এরাই রিদ্দা যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করে।
৯. ভৌগােলিক প্রভাবঃ ভৌগােলিক প্রভাবে আরবের লােকদের মন মস্তিষ্ক সুবিবেচক হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ফলে তারা অনেকেই ইসলামের স্বরূপ অনুধাবন না, করে ইসলামের অনুশাসনকে কঠিন ভেবে এর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে।
১০. নৈতিক অনুশাসনঃ নৈতিকতাহীন আরববাসী ইসলামের নৈতিক। অনুশাসন রুচিসম্মত ও মার্জিত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল না । চিরদিনই তারা ছিল দুরন্ত বাধা বন্ধনহীন। তাই মহানবীর জীবদ্দশায় আপাত সংযত থাকলেও তার ওফাতের পর তারা প্রাক-ইসলাম যুগের জীবন পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে।
১১. মহানবী (স)-এর সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হওয়াঃ মহানবী (স)-এর ওফাতের কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক লােক ইসলাম কবুল করেছিল। ফলে তারা সময় সুযোগের অভাবে কাঙ্ক্ষিত নৈতিক মানে উন্নীত হতে পারেনি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের সাথে সাথে তারা ইসলাম অস্বীকার করে বসে।
১২. দ্বীনের মর্মবাণী অনুধাবনে ব্যর্থতাঃ রাজনৈতিক প্রভাবে মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করলেও তারা ইসলামের সুমহান আদর্শ ও সঠিক মর্মবাণী উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। ঐতিহাসিক মুহাম্মদ আলী বলেন- They were like children just put in the school when the master passed away and without his teaching and control they drifted rudderless.
১৩. ইহুদি খ্রিস্টানদের উসকানিঃ মুরতাদ, বেদুইন, স্বার্থান্বেষী গােত্র ও ভণ্ডনবীদের অপতৎপরতা ছাড়াও ইহুদি খ্রিস্টানরা এ সুযােগে ইসলামের ধ্বংস সাধনে। সচেষ্ট হয়। তাদের উসকানিতেই এ আন্দোলন এক ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে।
১৪. নবী হওয়ার বাসনাঃ মহানবী (স)-এর অসামান্য মর্যাদা, সম্মান ও প্রতিপত্তি দেখে কিছু সংখ্যক কপট গােত্রপতি নিজেদেরকে নবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালায়। ফলে বিশৃঙখলা দানা বেঁধে ওঠে।
১৫. বিচার বুদ্ধির অভাবঃ সময় ও পরিবেশের প্রভাবে আরবের লােকদের মন ও মস্তিষ্ক সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হতে পারেনি। ফলে বিচার বুদ্ধি তাদের খুব ছিল না, তাদের অনেকেই বিনা যাচাইয়ে ইসলাম গ্রহণ এবং রাসূলুল্লাহ (স)-এর অবর্তমানে বিনা। যাচাইয়েই ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে।
রিদ্দার ঘটনাবলিঃ
১. যাকাত অস্বীকারীদের দমনঃ রাসূলুল্লাহ (স)-এর ওফাতের পর আরবের এক শ্রেণির লােক যাকাত দিতে অস্বীকার করে। তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে হযরত আবু বকর (রা) তাদের বিরুদ্ধে হযরত আলী, তালহা, যুবায়ের (রা) প্রমুখকে প্রেরণ করেন। মাত্র একদিনের যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়ে পুনরায় যাকাত প্রদানে সম্মত হয়।
২. ভণ্ডনবীদের দমনঃ রাসূলুল্লাহ (স)-এর ওফাতের পর বেশ কয়েকজন ভণ্ড প্রতারক নবুয়ত দাবি করে। এদের মধ্যে গাতফান ও আসাদ গােত্রের তুলায়হা, বনী তানিমের মহিলা সাজাহ ও মুসায়লামা উল্লেখযােগ্য। হযরত আবু বকর (রা) বেশ কটি যুদ্ধের মাধ্যমে এসব ভণ্ডনবীকে দমন করেন।
রিদ্দার যুদ্ধের ফলাফলঃ
১. ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণঃ রিদ্দার যুদ্ধে বিজয়ের ফলে বিদ্রোহী আরব গােত্রগুলাে পুনরায় ইসলামের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় এবং সমগ্র আরবে ইসলামের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
২. ঈমানী শক্তি বৃদ্ধিঃ রাসূল (স)-এর ওফাতের অল্পকালের মধ্যেই ইসলামের এ ধরনের ব্যর্থতা দেখে অনেক মুসলমানদের মনেও সংশয়ের উদ্রেক হয়। আবু বকর (রা)-এর দৃঢ় প্রতিরােধের মুখে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হলে মুসলমানদের অন্তরে ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পায়।
৩. মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়ঃ রিদ্দার যুদ্ধে জয়লাভ মূলত মিথ্যার ওপর সত্যের জয়। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, “সত্য এসেছে অসত্য দূর হয়েছে, নিশ্চয় অসত্য দূরীভূত হওয়ারই বিষয়”।
৪. পৌত্তলিকতার অবসানঃ এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের ফলে আরব ভূখণ্ড থেকে পৌত্তলিকতা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে সেখানে একত্ববাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধিঃ এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের শক্তি এত বেশি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় যে, তৎকালীন পৃথিবীর দু’পরাশক্তি রােমান ও পারসিকদের বিরুদ্ধে তাঁরা রুখে দাড়াতে সক্ষম হন।
৬. ইসলামের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়ঃ রিদ্দা যুদ্ধে বিজয়ের ফলে আরব উপদ্বীপে ইসলামের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর স্থায়িত্বের বুনিয়াদ দৃঢ় হয়।
৭. খােদাদ্রোহীদের আতঙ্কঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, রিদ্দার যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এবং বহির্বিশ্বে খােদাদ্রোহীদের আতঙ্কিত করে তােলে।
৮. শক্তিশালী রাষ্ট নিশ্চিত হয়ঃ এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে শিশু ইসলামী রাষ্ট্র একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। যে রাষ্ট্রের ভিত্তি মহানবী (স) নিজ হাতে স্থাপন করেছিলেন, তা হযরত আবু বকরের হাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
৯. আর্থিক সচ্ছলতাঃ যাকাত অস্বীকার করায় ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। রিদ্দার যুদ্ধে জয়লাভের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সচ্ছলতা ফিরে আসে।
১০. গভীর আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিঃ এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বিদ্রোহী গােত্রগুলাে আন্তরিকভাবে ইসলামে দীক্ষিত হলে যে আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়, তা ইসলামকে এক বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করে।
১১. জয়ের দিগন্ত উন্মােচনঃ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিশঙখলা দমনের পর আরবের বাইরে ইসলামের শক্তি সম্প্রসারণ করার অপূর্ব সুযােগ সৃষ্টি হয়। এ সুযােগকে কাজে লাগিয়ে আবু বকর (রা) ইরাক সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল জয় করেন। ফলে সাথে সাথে ইসলামের জয়ের দিগন্ত উন্মােচিত হয়।
১২. বিশ্ব বিজয়ের দ্বার উন্মুক্তঃ রিদ্দার যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইসলাম দ্রুতগতিতে আরব জাহানের বাইরেও বিস্তার লাভ করতে থাকে। তাই ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি বলেন- Arabia had to conquer itself before it could conquer the world.
পরােক্ষ ফলাফলঃ রিদ্দার যুদ্ধে মুসলমানরা নতুন নতুন কৌশল আয়ত্ত করে। সামরিক দিক থেকে আরাে শক্তিশালী হয়। রিদ্দা যুদ্ধের সময় রােমান ও পারসিকরা সীমান্ত প্রদেশে ধর্মত্যাগীদেরকে নানাভাবে সাহায্য করেছিল। তাই পরবর্তীকালে খলিফাগণ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে এর প্রতিশােধ নিতে বাধ্য হন। ফলে অল্পদিনের মধ্যে পারস্য ও রােমান সাম্রাজ্য মুসলমানদের দখলে আসে।
উপসংহারঃ বিদ্দার যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক চরম পরীক্ষা। এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মদিনার শিশু ইসলামী রাষ্ট্র দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পায়। অধ্যাপক পি. কে হিট্টি মন্তব্য করেন- The short Childphot wgs mostly.occupied with the s০ colled Riddch war. এ যুদ্ধে মুসলমানগণ পরাজিত হলে ইসলামের ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লেখা হতাে।
0 মন্তব্যসমূহ