চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলতে কী বুঝ? এর সুফল ও কুফল বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলতে কী বুঝ? এর সুফল ও কুফল বর্ণনা কর।

উপস্থাপনাঃ ভারত উপমহাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের জনক হলেন ইংরেজ গভর্নর লর্ড কর্নওয়ালিশ। এটা ছিল লর্ড কর্নওয়ালিশের উল্লেখযােগ্য সংস্কার। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এর দ্বারা জনগণের কোনাে কল্যাণ সাধিত হয়নি বিধায় কালক্রমে এ প্রথার বিলুপ্তি ঘটে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তঃ লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী আইন প্রণয়নের সুনির্দিষ্ট আদেশ নিয়ে গভর্নর জেনারেল হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনি প্রথমে বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার কোনাে কোনাে স্থানে এবং বারানসীতে দশসালা বন্দোবস্ত প্রদান করেন। পরবর্তীতে ১৭৯৩ সালে এ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করা হয়। লর্ড কর্নওয়ালিশ নিজেও একজন বড় জমিদার ছিলেন। তিনি জমিদারদের জমির চিরস্থায়ী মালিক বলে ঘােষণা দেন। প্রত্যেক জমিদার কত হারে সরকারকে খাজনা দেবে তাও চিরকালের জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তিনি আরাে ঘােষণা করেন, নির্দিষ্ট দিবসে সূর্যাস্তের পূর্বেই খাজনা পরিশােধ করলে তবেই জমিদাররা জমির চিরস্থায়ী মালিক থাকতে পারবে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলঃ
১. আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জনঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় কৃষিকার্য সম্প্রসারিত হয় এবং জমিদারদের আয় বৃদ্ধি পায়। এমনকি তারা জমিতে শ্রম ও মূলধন খাটাতেও ব্যাপক উৎসাহ বােধ করেন।

২. রাজভক্ত জমিদার শ্রেণির উদ্ভবঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে একটি রাজভক্ত জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা কোম্পানির নির্ভরযােগ্য সমর্থক শ্রেণিতে পরিণত হয়। এরা যে কোনাে দেশীয় আন্দোলন নিষ্ক্রিয় রেখে কোম্পানি এবং ব্রিটিশ রাজশক্তিকে পাকাপােক্ত করতে সহায়তা করে।

৩. রাষ্ট্রীয় বাজেট প্রণয়নে সুবিধাঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রাজস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হওয়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আয় সুনিশ্চিত হয়। এতে সরকারের বাজেট প্রণয়ন এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুবিধা হয়।

৪. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি এ দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখতে সমর্থ হয়। জনগণের মঙ্গলার্থে তারা দীঘি খনন, বিদ্যালয় স্থাপন, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন প্রভৃতি জনহিতকর কার্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। দুর্ভিক্ষ মহামারীর সময় তারা প্রজাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফলঃ
১. রাজস্ব নির্ধারণে ক্রটিঃ জমিদারের অধীনস্থ জমি কি ধরনের ছিল তা জরিপ না করেই রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়। জমিদারির প্রকৃত সীমানা নির্ধারিত না থাকায় প্রচুর মামলা মকদ্দমাও সৃষ্টি হয়েছিল।

২. সরকারি রাজস্বের ক্ষতিঃ ভূমি রাজস্ব চিরস্থায়ী হওয়ায় সরকারও রাজস্ব বাড়াতে সক্ষম ছিলেন না। সরকারের অর্থের প্রয়ােজন হলেও রাজস্ব বৃদ্ধি করা যেত না। ফলে জনগণের ওপর বিবিধ কর আরােপ করতে হতাে।

৩. ভূমি উন্নয়ন ব্যাহতঃ জমিদারগণ ভূমির উন্নয়ন সাধন করলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, এটাই ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রত্যাশা, কিন্তু এ প্রত্যাশা কোনােভাবেই পূর্ণ হয়নি। জমির উন্নয়ন না করলেও মালিকানায় হস্তক্ষেপ হবে না ভেবে জমিদাররা ভূমি উন্নয়ন থেকে বিরত থাকেন।

৪. প্রজাস্বত্ব বিলােপঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারদের উন্নতি হলেও প্রজাদের দুর্দশা বেড়ে গিয়েছিল। জমিতে প্রজাদের স্বত্ব স্বীকৃত ছিল না। ফলে প্রজাদের জমিদারদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হতাে।

৫. জমিদারি নিলামঃ জমিদারদের সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেলেও রাজস্ব অনাদায়ে তাদের জমিদারি নিলামে ওঠার আশঙ্কা ছিল। সূর্যাস্ত আইনানুসারে নির্দিষ্ট দিনের সূর্যাস্তের পূর্বে সরকারের রাজস্ব আদায় করতে না পারলে জমিদারি নিলাম হয়ে যেত। এ আইনের ফলে মাত্র ২২ বছরে প্রায় অর্ধেক জমিদার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

৬. নায়েব গােমস্তার অত্যাচারঃ পল্লী অঞ্চলে নাগরিক সুযােগ-সুবিধা না থাকায় সমৃদ্ধশালী জমিদারগণ গ্রামে বসবাস না করে কলকাতা ও বড় বড় শহরে বসবাস করতেন। ফলে তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের প্রতিনিধি নায়েব গােমস্তারা জমিদারি চালাত ও প্রজাদের ওপর অত্যাচার করত।

৭. মুসলমানদের ক্ষতিসাধনঃ পূর্বে রাজস্ব আদায় কার্যে মুসলমানগণ উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিযুক্ত হতেন, কিন্তু লর্ড কর্নওয়ালিশ তাদের সে অধিকার কেড়ে নিয়ে ইংরেজ কালেকটরের হাতে অর্পণ করেন। এছাড়াও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা প্রাচীন সম্রান্ত মুসলিম জমিদারদের সর্বনাশ করা হয়েছিল।

উপসংহারঃ লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা জনগণের কল্যাণে তেমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেনি। এ ব্যবস্থা জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করায় প্রজাসাধারণ অত্যাচারিত হয়। সর্বোপরি এ অসম ব্যবস্থা তার অন্তর্নিহিত ত্রুটির কারণেই বিলুপ্ত হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক