অথবা, হিউমের আত্মসত্তা বিষয়ক মতবাদটি আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ দর্শনে দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ের মতবাদের মধ্যে মূল মতানৈক্য সৃষ্টি করে মন বা আত্মার সংজ্ঞা, স্বরূপের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে। দর্শনে মন শব্দটি একটি অত্যন্ত ব্যাপক ক্ষেত্রকে নির্দেশ করে। সাধারণত মন একটা জটিল বিষয়। কেননা এই মনের সঙ্গে চেতনা, আত্মা প্রভৃতি বিষয়কে গুলিয়ে সাধারণ মানুষেরা এর আলােচনাকে আরাে জটিল করে তােলেছেন। দর্শনের সৃষ্টিতে এসব ধারণা গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। তাই দার্শনিকগণ যুগে যুগে মনের প্রকৃত স্বরূপকে উন্মােচনের চেষ্টা করেন। হিউমের আত্মসত্তা বিষয়ক মতবাদ হলাে এসব প্রচেষ্টার মধ্যে অন্যতম।
হিউমের আত্মসত্তা বিষয়ক মতবাদঃ মন সম্পর্কিত সাবেকি ধ্যান-ধারণা হিউমের চিন্তায় আমূল পরিবর্তন ঘটে। অভিজ্ঞতাবাদের জনক হিউমের মতে, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাই জ্ঞান লাভের একমাত্র পন্থা। তাই যাকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যাচাই করা যায় না, তার অস্তিত্বও স্বীকার করা অর্থহীন দার্শনিকেরা মন নামক এক স্থায়ী আধ্যাত্মিক দ্রব্যের কথা বলেছেন। কিন্তু হিউম বলে, এরকম স্থায়ী কোনা দ্রব্যের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা আমাদের কখনই হয় না। অভিজ্ঞতায় আমরা কোনাে অপরিবর্তিত আত্মার সন্ধান পাই না। অভিজ্ঞতায় আমরা মন বলতে যা পাই তা হলাে চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াগুলাের পরিবর্তনশীল ধারা। যে আত্মচেতনা দার্শনিকদের মন নামক দ্রব্যটিকে স্বীকার করতে বাধ্য করে, তার উদ্দেশ্যে হিউম বলেন, গভীর ঘুমে আমার অভিজ্ঞতা দুরীভূত হয়ে যায় তখন কিন্তু আমিত্বের কোনাে অস্তিত্ব থাকে না।
অভিজ্ঞতার সংবেদনের সমষ্টিই মন বা আত্মাঃ মৃত্যুর আগমনে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলাে অকেজো হয়ে পড়ে, অভিজ্ঞতা লােপ পায়, সংবেদনে কিছুই পায় না। ফলে আত্মা অস্তিত্বশীল বলে মনে করা হয়। সুতরাং অভিজ্ঞতা যা সংবেদনই একমাত্র বস্তু যার মাধ্যমে মন সম্পর্কে ধারণা করা হয়েছে। হিউম বলেন, অভিজ্ঞতায় মন বলে কিছু পাওয়া যায়। সংবেদনের সমষ্টিকেই আমরা মন বলে থাকি।
মনকে রঙ্গমঞ্চের সাথে তুলনাঃ হিউম তার গ্রন্থে মানুষের তথা কথিত মনকে একটা রঙ্গমঞ্চের সাথে তুলনা করেন। যেখানে সংবেদনগুলােই হচ্ছে অভিনেতা-অভিনেত্রী। যেগুলাে মঞ্চে আসছে, ঘােরাফেরা করছে তারপর চলে যাচ্ছে। তবে মন স্থির নয়। প্রকৃতপক্ষে মন হলাে নিয়ত পরিবর্তনশীল সংবেদন, অনুভূতি ও ধারণার পারম্পর্য।
সংবেদনের ঐক্যসাধনঃ মন যদি স্থায়ী সত্তা না হয়, তাহলে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন সংবেদনগুলাের যােগাযােগ বা ঐক্য-সাধন কীভাবে হয়ে থাকে? এক্ষেত্রে হিউম বলেন, আমরা এটা করে থাকি অনুষঙ্গের তিনটি নিয়মের মাধ্যমে। এগুলাে অনুষঙ্গের কোনাে না কোনাে নিয়ম দ্বারা শাসিত। বা সমালােচনা ও হিউম মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার না করেই তার দর্শনে ‘আমি’, ‘আমার’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা মূলত অভিজ্ঞতার বাইরে স্থায়ী সত্তাকেই বােঝানাে হয়ে থাকে। তা ছাড়া হিউমের রঙ্গমঞ্চের সাথে মনের তুলনা দিতে গিয়ে মনের স্বরূপগত ঐক্যকে অস্বীকার করেছেন। তাই তার মতানুসারে ব্যক্তি অভিন্নতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আত্মা বা মন সম্পর্কিত হিউম ও তার অনুসারীদের মতবাদ সন্তোষজনক না হলেও এটা মন সম্পর্কিত সাবেকি চিন্তা-চেতনার মূলে আঘাত করেছে। সাবেকির মতে, মন হাজার বছরের পুরানাে একটি ধারণাকেই বুঝাচ্ছে। তাই হিউমের আত্মসত্তা সম্পর্কিত মতবাদের গুরুত্ব দর্শনে অপরিসীম।
0 মন্তব্যসমূহ