ফরায়েজী আন্দোলন বলতে কী বুঝ? এ আন্দোলনে হাজী শরীয়তুল্লাহর ভূমিকা আলােচনা কর


প্রশ্নঃ ভারত উপমহাদেশের ফরায়েজী আন্দোলন সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, ফরায়েজী আন্দোলন বলতে কী বুঝ? এ আন্দোলনে হাজী শরীয়তুল্লাহর ভূমিকা আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ ইংরেজ সরকার যখন কঠোর নির্যাতনের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের ঈমান, আকিদা, ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতি সর্বস্বান্ত করার অসমনীতি গ্রহণ করে, ঠিক সে সঙ্কটময় মুহূর্তে ইসলামের সত্য সুন্দর জীবনবিধানের আলােকে মুসলিম সমাজকে পুনর্গঠিত করতে যিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তিনি হচ্ছেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তার নেতৃত্বে যে আন্দোলন পরিচালিত হয় তাই ফরায়েজী আন্দোলন।

ভারত উপমহাদেশের ফরায়েজী আন্দোলনঃ
১. ফরায়েজী আন্দোলনের পটভূমিঃ ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্র কাননে মুসলমানদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংরেজ শাসনাধীনে মুসলমানরা চরম অবক্ষয়ের সম্মুখীন হন। এ অবক্ষয়ের গ্লানী থেকে রক্ষার জন্য হাজী শরীয়তুল্লাহ মক্কা থেকে প্রত্যাবর্তন করে ১৮১৮ সালে ফরায়েজী আন্দোলনে আত্মনিয়ােগ করেন।

২. ফরায়েজী আন্দোলন পরিচিতিঃ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৎকালীন বাঙালি মুসলিম সমাজে পীর পূজা, কবর পূজা, ফকীর পূজা ইত্যাদি কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। এসব কারণে হাজী শরীয়তুল্লাহ গভীরভাবে বিচলিত হন। তিনি মুসলিম সমাজকে এসব বিভীষিকাময় অবস্থা ও ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান এবং বিরত থাকাকে ফরয তথা অবশ্য করণীয় বলে ঘােষণা করেন। এসব ফরয। তথা অবশ্য করণীয় অনুসারে তার আন্দোলনের নামকরণ হয় ফরায়েজী আন্দোলন।

৩. ফরায়েজী আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ কয়েকটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে ফরায়েজী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। যেমন-

ক. সকল মুসলমানকে ইসলামী মূলনীতি তথা ফরযের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা।

খ. ইসলাম বিরােধী কার্যকলাপ ও কুসংস্কাররােধে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করা এবং আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সকল অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করা।

গ. অধিকার আদায়ে মুসলমানদের সচেতন ও আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তােলা।

৪. ফরায়েজী আন্দোলনে হাজী শরীয়তুল্লাহর অবদানঃ ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে ইংরেজ বিরােধী আন্দোলনে হাজী শরীয়তুল্লাহ এক অমর কৃতিত্ব রেখে গেছেন। ১৭৬৪ সালে জন্মগ্রহণকারী ফরিদপুরের কৃতী সন্তান হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৮ বছর বয়সে পবিত্র হজ্জ পালন করতে মক্কায় গমন করেন। তিনি ২০ বছরকাল আরব দেশে অবস্থান করে ধর্মীয় শিক্ষায় বিশেষভাবে শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি মক্কা শরীফে ওহাবী আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন। ১৮০২ সালে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে এখানকার মুসলমানদের মধ্যে তার মতবাদ প্রচার আরম্ভ করেন এবং মুসলিম সমাজে বিদ্যমান গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিষয়ে ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণা দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কারণ ইসলামের নামে যে সকল রীতি প্রথা প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলাে দূর করে ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও সামাজিক, রাজনৈতিক, সংস্কার ছিল হাজী শরীয়তুল্লাহর আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। তার আদর্শে গ্রামবাংলার কৃষক, মজুর ও দরিদ্র জনসাধারণই অধিক পরিমাণে অনুপ্রাণিত হয়। ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও বরিশাল জেলার অনেক লােক তার আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিল। তিনি বাংলার কৃষক, মজুর ও খেটে খাওয়া মানুষদের সংগঠিত করে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক ও তাদের দোসর অত্যাচারী জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন পরিচালনা করেন। ব্রিটিশ শাসকগােষ্ঠী ও তাদের স্থানীয় দোসর জমিদার শ্রেণি সর্বদা তার ভয়ে ভীত থাকত। তিনি বৃটিশ শাসনের কবল থেকে প্রিয় স্বদেশকে মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। দেশবাসীর অনুভূতি চাঙ্গা করার জন্য তিনি এ দেশকে ‘দারুল হরব’ তথা ‘শত্রু কবলিত’ অঞ্চল ঘােষণা করে মুসলমানদের জন্য এ দেশে জুমা ও ঈদের নামায অনাবশ্যক বলে ঘােষণা করেন।

ইংরেজ শাসক, শােষক ও অত্যাচারী জমিদার শ্রেণির অক্টোপাস থেকে নিরীহ জনসাধারণ, দরিদ্র কৃষক ও ক্ষেতমজুর শ্রেণিকে মুক্ত করার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ঢাকা জেলার নয়া বাড়িকে কেন্দ্র করে গণআন্দোলন গড়ে তােলেন। স্বৈরাচারী ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তিনি জনমনে গভীর ক্ষোভ সঞ্চারিত করে বিপ্লবের দাবানল প্রজ্বলিত করেন। তার পরিচালিত ফরায়েজী আন্দোলন ছিল বিদেশি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তি পাগল মানুষের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।

৫. ফরায়েজী আন্দোলনে দুদু মিয়ার ভূমিকাঃ হাজী শরীয়তুল্লাহর সুযােগ্য পুত্র মুহাম্মদ মােহসেনুদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। ফরায়েজী আন্দোলনের স্রষ্টা হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তিনি বাংলার কৃষক, মজুর ও খেটে খাওয়া মানুষদের সংগঠিত করে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক ও তাদের দোসর অত্যাচারী জমিদার-নীলকরদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তােলেন। তাকে কাবু করার জন্য ব্রিটিশ শাসকরা নানাবিধ কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেও স্বীয় পথ থেকে তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি অসীম সাহসিকতা ও পর্বতপ্রমাণ ধৈর্যের সাথে সকল অত্যাচার, উৎপীড়ন উপেক্ষা করে আপন মতে অবিচল থাকেন। তার সংগঠন অত্যন্ত শক্তিশালী ও সুসংগঠিত ছিল।

৬. ফরায়েজী আন্দোলনের ফলাফলঃ ফরায়েজী আন্দোলনের ফলাফল সুদূর প্রসারী। কেননা এ আন্দোলনে গ্রাম বাংলার কৃষক, মজুর ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। এমনকি আন্দোলন, এক সময় ভারত বিভক্তি আন্দোলনের চেতনা হিসেবে কাজ করে।

উপসংহারঃ ভারতবর্ষে মুসলিম পুনর্জাগরণে ফরায়েজী আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ আন্দোলনের অগ্রনায়ক হাজী শরীয়তুল্লাহ উপমহাদেশে ইসলামকে বিদয়াত ও কুসংস্কারের তিমির অমানিশা থেকে মুক্ত করতে তুলনাতীত ভূমিকা রেখেছিলেন। এ আন্দোলনের অনুপ্রেরণাই পরবর্তীতে বাংলার স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপদান সহজতর করেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক