আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের সার্থকতা বিচার কর


প্রশ্নঃ আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের সার্থকতা বিচার কর।

অথবা, আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার কর।

অথবা, আঞ্চলিক উপন্যাস কাকে বলে? আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের সার্থকতা বিচার কর।

উত্তরঃ নদী তীরবর্তী অন্ত্যজ মানবপ্রবাহের ভাঙা-গড়ার ছন্দে আন্দোলিত জীবনের বিশাল ক্যানভাস অবলম্বিত হয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১) রচিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে। বিষয়ভাবনা ও শিল্পরূপ বিচারে এ গ্রন্থ আঞ্চলিক উপন্যাসের প্রায় শর্তই পূরণ করেছে। ভৌগােলিক সীমাসংহতি, মানবমনের ওপর ভূ-প্রকৃতির সর্বাত্মক প্রভাব, মানুষে-প্রকৃতিতে অন্তরঙ্গ যােগ, জীবন-স্বাদের অনন্য একমুখীনতা ও সার্বভৌমতা যেমন এ উপন্যাসে বিদ্যমান, তেমনি চরিত্রায়ণ, দৃষ্টিকোণ ও ভাষাবিন্যাসে নির্দিষ্ট ভৌগােলিক কাঠামাের জীবন প্রাণময় রূপ লাভ করেছে। মহাকাব্যিক ফ্রেমের মধ্যে যে জীবনকে রূপদান করেছেন ঔপন্যাসিক তা নদীর মতােই কখনাে বাকপরিবর্তনকারী, ভাঙন ও নির্মাণশীল। এ উপন্যাসটি সমগ্র বিশ্বের নদীমাতৃক জেলে জীবনােপাখ্যানের মহাকাব্য।

‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর তীরবর্তী মালাে জেলেদের কর্ম-ধর্ম-স্বপ্ন সংস্কৃতিভিত্তিক জীবন নিয়ে রচিত। শুধু এ অঞ্চলের মানুষের কাহিনি এবং তার সীমার মধ্যেই সেটি আবদ্ধ থেকেছে। এমনকি কাহিনিটি নিকটস্থ কুমিল্লাতেও বিস্তৃত হতে পারেনি। সে কারণে, উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে একটি অঞ্চলভিত্তিক। সেদিক থেকে বলা যেতে পারে ‘তিতাস একটি নদীর নাম' একটি ভৌগােলিক অঞ্চল নির্ভর হয়ে সূচিত ও বিকশিত হয়েছে। ঐ অঞ্চলের অখণ্ডতা কাহিনির কোন পর্যায়ে খণ্ডিত হয়নি। উক্ত অঞ্চলের বাইরের মানুষ ও প্রকৃতির ব্যাপক কোনাে খোজ খবরও উপস্থাপিত হয়নি এ রচনায়। উপন্যাসটির নির্দিষ্ট ভৌগােলিক পরিসরের মধ্যে থেকে উপন্যাসের চরিত্রগুলাে নিয়ত সংগ্রামশীল থেকে বেঁচে থাকার জন্য। চলমান জীবনে তাদের দুঃখবহ পরিণতি রচনার কুশলতায় গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। এসব বৈশিষ্ট্যের আলােকে ‘তিতাস একটি নদীর নাম'কে অনেকে আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একজন সমালােচন বলেছেনঃ
“‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় যে জীবনকে অঙ্কন করেছেন, সে জীবন নগর কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত মানসের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত। তিতাস বিধৌত জনপদের স্থানিক বর্ণনার সঙ্গে সে অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার বিশ্বস্ত রূপায়ণসূত্রে এ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাস সাহিত্যে এটি একটি কালজয়ী সংযােজন।”
‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে তিতাস এবং তিতাস তীরবর্তী অঞ্চলের local color and habitations পরমসূক্ষ্ম পরিচর্যায় উপস্থাপিত হয়েছে। একটি আঞ্চলিক উপন্যাসে কাহিনির একটি অঞ্চলভিত্তিক নির্ভরতা থাকে অপরিহার্যভাবে। এ বিষয়ে একজন সমালােচক বলেছেনঃ
“কোন একটি বিশেষ অঞ্চলের অনুপুঙ্খ সেই অঞ্চলের মানুষের পেশাগত বৈশিষ্ট্য আর ভৌগােলিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের পরস্পরিত সম্পর্ক। আসলে ভৌগােলিক পরিবেশ আর মৌলিক বৃত্তির লােকায়ত মানুষ এরই টানাপােড়েনে নিখুঁতভাবে বিন্যস্ত হয় আঞ্চলিক উপন্যাস।”
আঞ্চলিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরাে একজন সমালােচক জানিয়েছেন, "A regional writer is one who concentrates much attention on a particular area and uses it and the people who inhabit it as the basis of his or her stories, Such a locale is likely to be rural and or provincial."

শুধু কল্পনা ও অনুভূতি দিয়ে কোন অঞ্চলের স্থানীয় বৈশিষ্ট্য উপন্যাসে উপস্থাপন করা একজন লেখকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবস্থানের মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা যদি লেখকের কল্পনা ও অনুভূতির সঙ্গে সমন্বিত হয়, তা হলে জন্ম নিতে পারে একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ক্ষেত্রে প্রায় এমনটি ঘটেছে বলা যেতে পারে। মালাের সন্তান অদ্বৈত তিতাস পাড়ের মালো জীবনের সঙ্গে আজন্ম সম্পর্কিত। মালােদের জীবনের বঞ্চনা ও যন্ত্রণার সঙ্গে সুপরিচিত বলেই অদ্বৈতের পক্ষে এ ধরনের একটি উপন্যাস লেখা সহজতর হয়েছে। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের ‘তিতাস একটি নদীর নাম' অধ্যায়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাসের রং রেখা স্বভাব দার্শনিকতামণ্ডিত করে পরিবেশন করেছেন। ‘প্রবাস খণ্ডের’ শুরুতে তিনি মালােপাড়ার অবস্থা অবস্থান, ঘর গেরস্থালির স্বরূপ অঙ্কন করেছেন এভাবেঃ
“তিতাস নদীর তীরে মালােদের বাস। ঘাটে বাঁধা নৌকা, মাটিতে ছড়ানাে জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তকলি সুতা কাটার, জাল বােনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালােদের সংসার। নদীটা যেখানে ধনুকের মত বাকিয়াছে, সেইখান হইতে গ্রামটার শুরু। মস্ত বড় গ্রামটা তার দিনের কলরব রাতের নিশুতিতেও ঢাকা পড়ে না। দক্ষিণপাড়াটাই গ্রামের মালােদের।”
মালাে সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি যে সমাজের নিম্নতম স্তর পর্যন্ত এর আবেদন সঞ্চারিত করে সর্বসাধারণকে রুচি ও অনুভূতির এক মহিমাম্বিত পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিল, তার কারণ এর অসাধারণ প্রাণশক্তি। উপন্যাসের এতদসংক্রান্ত একটি এলাকা লক্ষণীয়ঃ
“মালােদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি ছিল। গানে গল্পে প্রবাদে এবং লােকসাহিত্যের অন্যান্য মালমসলায় যে সংস্কৃতি ছিল অপূর্ব। পূজায় পার্বণে, হাসিঠাট্টায় এবং দৈনন্দিন জীবনের আত্মপ্রকাশের ভাষাতে তাদের সংস্কৃত ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মালাে ভিন্ন অপর কারাে পক্ষে সে সংস্কৃতির ভিতরে প্রবেশ করার বা তার থেকে রস গ্রহণ করার পথ সুগম ছিল না। কারণ মালােদের সাহিত্য উপভােগ আর সকলের চাইতে স্বতন্ত্র পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত তাদের গানগুলাে ভাবে যেমন মধুর, সুরেও তেমনি অন্তরস্পর্শী। সে ভাবের, সে সুরের মর্ম গ্রহণ অপরের পক্ষে সুসাধ্য নয়। ইহাকে মালােরা প্রাণের সঙ্গে মিশাইয়া নিয়াছিল, কিন্তু অপরে দেখিত ইহাকে বিদ্রুপের দৃষ্টিতে। আজ কোথায় যেন তাদের সে সংস্কৃতিতে ভাঙ্গন ধরিয়াছে।”
একটি আঞ্চলিক উপন্যাসের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে নির্দিষ্ট ভৌগােলিক পটভূমির সঙ্গে লেখকের অন্তরঙ্গ সংশ্লিষ্টতা। তিতাস নদীর উৎসস্থল ও মােহনার মাঝামাঝি সাদকপুর থেকে নবীনগর, গােকনঘাট, আমিনপুর, বিরামপুর, ভৈরববাজার, নয়াকান্দা, শুকদেবপুর, উজানিনগর পর্যন্ত বিস্তৃত নদীর প্রবাহ পথই এ উপন্যাসের নির্বাচিত ভৌগােলিক পরিবেশ প্রসঙ্গে উপন্যাসে বলা আছে যে, ঝড় তুফানের রাতেও তিতাসের বুকে মাছ ধরতে যাওয়া স্বামীপুত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয় না স্ত্রীরা, মায়েরা। কারণ, তিতাস প্রকৃতিতে শান্ত।

এ ভৌগােলিক পরিসরে অবস্থানকারী জনগােষ্ঠীর জীবন তিতাস নদী ও তার আচরণের বাইরে খুব একটা যায়নি। এ উপন্যাসের কাহিনি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রথাগত সাংগঠনিক কাঠামাে অনুসৃত হয়নি বললেই চলে। তিতাস তীরের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়েই যেন উপন্যাসটি তৈরি করা হয়েছে। লেখক যেন প্রকৃতির মতাে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে তার চিত্রগুলাে সাজিয়ে গেছেন। তবে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার প্রতিবেশের সঙ্গে উপন্যাসের মূল সুরের রয়েছে সুগভীর ঐক্য।

উপন্যাসটির কাহিনি বা ঘটনার সূত্রপাত ঘটে পূজা ব্রতকে কেন্দ্র করে, দিননাথ মালাের মেয়ে বাসন্তীর মাঘমণ্ডলের ব্রতে চৌয়ারি বানানাে এবং ভাসানাে নিয়ে। এ পূজার মাধ্যমে কুমারী মালাের কন্যারা উপযুক্ত বর প্রার্থনা করা। কিশাের ও সবলের মাধ্যমে তৈরি হয় বাসন্তীর চৌয়ারি। তা কেন্দ্র করেই দূরন্ত দুই বালকের অনুরাগ জন্মে বাসন্তীর প্রতি। কুমারী কন্যাদের জন্য চৌয়ারি ব্যবস্থার মাধ্যমে বর প্রার্থনা জেলেদের রীতি। শত দুঃখবেদনার মধ্যে তারা তাদের এ উৎসব অনুষ্ঠান করে থাকে। এখানে এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির ঘটে স্বাভাবিক যােগাযোগ। এর মধ্য দিয়েই সূচিত হয় কিশাের, সুবল ও বাসন্তীর ভবিষ্যতের জীবনবােধ। কিশােরের প্রতি বাসন্তীর অনুরাগ প্রকাশ পায় তার কথায়। সুবলের মধ্যেও কিশাের ও বাসন্তীর পরস্পরের প্রতি অনুরাগ সম্পর্কিত ধারণা বদ্ধমূল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বাসন্তী ও সুবলের বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে কিশাের।

শুকদেবপুরে অবস্থান করার মধ্যে যেন কিশােরের জীবনবােধের পরিবর্তন ঘটে। সেখানে খলা বাইতে যাওয়া আসার পথে নদী প্রকৃতির বহু বিচিত্র রূপ কিশাের সুবলের জীবনের সঙ্গে যেন নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। নদী পথেই তারা সেখানে উপস্থিত হয়েছে। নদীকে অবলম্বন করেই যেন কিশাের লাভ করেছে সুন্দরী নর্তকী স্ত্রী। আবার নদী পথেই ডাকাত হরণ করেছে তার স্ত্রী ও অর্থ। নদী পথ অথবা নদীনির্ভর জীবন প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ। মেঘনার যে মােহনায় তারা বিপদগ্রস্ত হলাে সেটিও বিপদসঙ্কুল। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসে বলা আছেঃ
“মােহনাটি সত্যই ভয়ংকর। এপার হইতে ওপারের কূল কিনারা চোখে ঠাহর করা যায় না। হু হু করিয়া চলিতে চলিতে স্রোত এক একটা আবর্তের সৃষ্টি করিয়াছে। দুই ধারের স্রোত মুখােমুখি হইয়া যে ঝাপটা খাইতেছে, তাহাতে প্রচণ্ড শব্দ করিয়া জল অনেক উপরে উঠিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে।"
নদীই যেন বাসন্তীকে ভাসিয়ে এনেছে সুবলের কাছে। আবার সে নদীই কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ। নদীর উত্থান পতনের ঢেউই যেন সুখ দেয়নি বাসন্তীকে। স্বামীর মৃত্যুতে তাকে আজীবন থাকতে হয়েছে বিধবা। নদীই তার দুঃখের মূল। চার বছর পর কিশােরের স্ত্রীর অনন্তসহ গােকনঘাটে ফিরে আসা এ উপন্যাসের উল্লেখযােগ্য বাঁক। নদীর সঙ্গে এমন সাক্ষাৎ না ঘটলে গােকনঘাটের কঠিন বাস্তবতা তাকে করতাে না স্পর্শ। সুতাে কাটার কাজ করে তাকে করতে হতাে না জীবিকা নির্বাহ। উপন্যাসে আঞ্চলিকতা প্রসঙ্গে জীবন বাস্তবতার এ দৃষ্টান্ত অনেকটা যথার্থ। একইভাবে বিবেচনাযােগ্য গােকনঘাটে অনন্তর মায়ের স্থায়ী বসতি হওয়া। এ বিষয়ে বলা আছেঃ
“অবশেষে উঠিল অনন্তর মার কথা। তার বুক দূর দূর করিতে লাগিল। এ কথাটাও ভারতকেই তুলিতে হইল, নতুন যে লােক আসিয়াছে, আপনারা সকলেই শুনিয়াছেন। তারে নিয়া কীভাবে সমাজ করিতে হইবে আপনার বলিয়া যান। তারে কার সমাজে ভিড়াইবেন, কিষ্ট কাকার, না দয়াল কাকার, না বাসন্তীর বাপ কাকার.... রামপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করিল, কারে কারে লইয়া তাের সমাজ? সুবলার শ্বশুর আর কিশােরের বাপেরে লইয়া। তা হইলে নতুন মানুষ লইয়া তাের সমাজ হইল চাইর ঘর। হ কাকা।”
শুধু মালােরাই নয়, তিতাস তীরের মুসলমানদের জীবনের সঙ্গেও নদীর সংযুক্ত গভীরভাবে। তিতাসকে কেন্দ্র করে। তাদের জীবনও আবর্তিত। কাদির মিয়া ছাদির মিয়ার মাধ্যমে সে নির্ভরশীলতার চিত্র ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য আলু বাজারে নেওয়া হয় নদী পথেই। সে সময়ের তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ নদীর ছবি উপন্যাসের উপস্থাপিত হয়েছে বাস্তবভাবে। জন্ম-মৃত্যু বিয়ের ক্ষেত্রে মালাে সমাজের নিয়ম নীতি, ধর্মাচার, এমনকি মায়ের মৃত্যুর পর সন্তানের হবিস্যি পালনের প্রথাও উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। শুধু গােকনঘাট নয়, নবীনগরের মানুষের জীবনাচারের নানা প্রসঙ্গও উপস্থাপিত হয়েছে উপন্যাসের এ পর্যায়ে। একটি এলাকার নানাবিধ বিবরণ ও চিত্র থাকায় তিতাস একটি নদীর নাম আঞ্চলিক উপন্যাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

উপন্যাসের ‘রাঙা নাও’ পর্বে স্থানীয় পরিবেশ আরাে ভালােভাবে ফুটে উঠেছে। নৌকা বাইচ একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এর সঙ্গে জড়িত কাঠ সংগ্রাহক, করাতি, মিস্ত্রি নকশাকার প্রভৃতি। প্রতিযােগীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাউল ভাটিয়ালি গায়কদের অবেগময় উচ্ছ্বাস তিতাস তীরবাসীদের জীবনে আনন্দ সঞ্চারক। কাহিনির এক পর্যায়ে নদীই কাছে এনে দিয়েছে অনন্ত ও অনন্তবালাকে তৈরি করেছে রমু ও অনন্তর বন্ধুত্ব। অনন্তবালা গড়তে চেয়েছে অনন্তর সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক অনন্তর জীবনে নদী এসেছে বার বার নদীর বাঁকের মতােই। অন্ত নদী পথেই গােকনঘাট এসেছিল। এখানে মা মারা যাওয়ার পর নদীর আশেপাশে ঘুরে ফিরে অনন্ত সঙ্গী হয় উদয়তারা ও বনমালীর। তাদের সঙ্গে নদীপথে নবীনগর আসে সে। এখানে এসেই সে যেন পায় তার জীবনের সঠিক ঠিকানা। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নাপতানির পরামর্শে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কুমিল্লা শহরে চলে যাওয়ার পেছনেও যেন নদী থেকেছে ক্রিয়াশীল।

এ উপন্যাসে একমাত্র অনন্তই তিতাস পরিধির বাইরে গেছে, অন্য সব চরিত্র থেকেছে তিতাস নদীর আওতায়। মালাে সম্প্রদায় এতই প্রকৃতি নির্ভর এবং সেই অর্থে অসহায় যে, তিতাসই যেন তাদের ঈশ্বর। তিতাসের বুকে চর জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মাছ ধরার পথ বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে যায় তাদের অর্থ উপার্জনের উৎস। তাদের ক্ষুধা আছে, কিন্তু তা নিবৃত্তির বিকল্প কোন পথ নেই তিতাসে মাছ ধরা ছাড়া। ফলে দ্রুত তাদের জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। সংগত কারণেই এই উপন্যাসের কাহিনিতে তিতাস নদী পালন করেছে বড় একটি ভূমিকা।

তিতাস একটি নদীর নাম- উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় যে জীবনকে অঙ্কন করেছেন, সে জীবন নগর-কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত-মানসের অভিজ্ঞতা-বহির্ভূত। তিতাস-বিধৌত জনপদের বর্ণনার সঙ্গে সে অঞ্চলের মানুষের। জীবনযাত্রায় বিশ্বস্ত রূপায়ণসূত্রে এ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ কারণে একজন সমালােচক বলেছেনঃ
“আঞ্চলিক জীবনের সরল ও নিপুণ বিন্যাসে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে অসাধারণত্বে ভাস্বর।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক