মানব জাতিতত্ত্ব কাকে বলে? পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি উপজাতির জীবনধারা বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ মানব জাতিতত্ত্ব কাকে বলে? পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি উপজাতির জীবনধারা বর্ণনা কর।

অথবা, মানব জাতিতত্ত্ব বলতে কী বুঝ? এ প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি উপজাতির জীবনধারা বিশ্লেষণ কর

ভূমিকাঃ বাংলাদেশে প্রায় ২০টির মতাে উপজাতির বসবাস রয়েছে। প্রত্যেকটি উপজাতি তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র সাধারণ জনগণ থেকে এবং এ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য তারা নিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে । যদিও শিক্ষাক্ষেত্রে ইদানীংকালে তাদেরকে বাংলা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তবে জাতি হিসেবে তারা স্বতন্ত্র। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলােতে এদের বাসস্থান গড়ে ওঠেছে। চাকমা, গারাে, মারমা, হাজং, ওরাও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। নিম্নে আমরা চাকমা উপজাতির জীবনধারা আলােচনা করবাে।

মানব জাতিতত্ত্ব কাকে বলেঃ মানব জাতিতত্ত্ব মূলত মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনধারা নিয়ে আলােচনা করে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় দিকগুলাে অনুশীলন করে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ মানব জাতিতত্ত্ব মূলত বিভিন্ন জাতির জীবনধারার তুলনামূলক আলােচনা করা হলাে-

F. W. Voget তার A History of Ethnology গ্রন্থে বলেন, "It also means a synthetic fusion of ethnographic field data as a preliminary to more theoretical analysis. Elsewhere it has become a synonym for cultural anthropology or even folklore."

বিলস্ ও হয়েজার (Beals and Hoijer) বলেছেন, “প্রত্নতত্ত্বের যেখানে শেষ মানব জাতিতত্ত্বের সেখান থেকে শুরু।” মূলত মানুষের সাংস্কৃতিক/জীবনপ্রণালির বর্ণনার মানব জাতিতত্ত্ব।

বাংলাদেশের চাকমা উপজাতির সাংস্কৃতিক জীবনধারাঃ বাংলাদেশে অন্যান্য উপজাতিদের চেয়ে অনেক বেশি প্রগতিশীল চাকমা উপজাতি। পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে চাকমাদের বাস। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে তাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা আলোচনা করা হলো-

(১) চাকমা নামকরণঃ বয়স্ক শিক্ষিত চাকমারা নিজেদের জন্য চাকমা নামটি ব্যবহার করে। তবে তাদের বৃহত্তর গ্রামবাসীরা চাকমা নামেই নিজেদের পরিচয় দেয়। নৃ-তাত্ত্বিক রিজলের মতে, ব্রম্ভাষার সাক বা সেক জাতি থেকে চাকমাদের উৎপত্তি। ক্যাপ্টেন লুহন বলেন, "The name chakma, probably has been given by the inhabitants of Chittagong."

(২) উৎপত্তি ও ইতিহাসঃ মগদের মতে, চাকমারা মুঘলদের বংশধর। এককালে মুঘলগণ আরাকানের হাতে পরাজিত হলে আরাকান রাজ তাদের বন্দী করে আরাকানী নারীদের সাথে বিবাহ দেন। এসব মুঘল সৈন্যের ঔরষে- আরাকানী নারীদের গর্ভে যে জাতির উদ্ভব হয়েছিল তারাই সাক বা সেক। চাকমা পুরাকাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে, চাকমারা চমক নগরে বাস করতাে। এক চাকমা রাজপুত বার্মার আরাকানের কিছু অঞ্চল নবম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করে। অতঃপর স্থানীয় আরাকানীদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস শুরু করে।

(৩) চাকমা জনসংখ্যাঃ বাংলাদেশে উপজাতিদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে চাকমারা সর্বাধিক। ১৯৯১ সালে করা এক আদমশুমারিতে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায়, ৩,৪০,০০০ জন চাকমা বাস করে। চাকমারা বাংলাদেশের মােট আদি উপজাতীয়দের প্রায় অর্ধেক।

(৪) ভাষাঃ অন্যান্য উপজাতিদের থেকে চাকমাদের ভাষা স্বতন্ত্র। চাকমারা বর্তমানে একটি বাংলা উপভাষায় কথা বলে, যাকে তারা চাকমা বা চাঙমা ভাষা বলে। তবে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, তারা পূর্বে টিবে-টো-বর্মান ভাষা পরিবারভুক্ত আরাকানী ভাষায় কথা বলতাে।

(৫) চাকমাদের ধর্মঃ অধিকাংশ চাকমা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। গ্রাম্য এলাকায় মাঝে মধ্যে বৌদ্ধ মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্মী হলেও তাদের মধ্যে দু'ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তারা গঙ্গা পুজা ও লক্ষী পূজা করে, যা হিন্দু ধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে শুভ-অশুভ বহু দেব দেবী বর্তমান। তন্মধ্যে গােজেন নামক ঈশ্বরকে তারা খুবই ভক্তিশ্রদ্ধা করে। তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ১৭টি।

(৬) চাকমাদের নরগােষ্ঠিগত পরিচয়ঃ চাকমাদের সাথে চীনা মঙ্গোলয়েডদের যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। তাদের উচ্চতা মাঝারি থেকে বেটে। দৈহিক গড়নে এরা শক্তিশালী। গায়ে লােমের স্বল্পতা, চ্যাপ্টা নাক ও ক্ষুদ্র চোখ লক্ষ্য করা যায়।

(৭) চাকমা পরিবারঃ চাকমা পরিবার পিতৃতান্ত্রিক। চাকমা পরিবারে সম্পত্তি বা বংশ পরিচয় পিতা থেকে পুত্রে বর্তায়। চাকমারা সাধারণত এক বিবাহভিত্তিক অনু পরিবারে বাস করে।

(৮) বিবাহ প্রথাঃ বিবাহের ব্যাপারে চাকমা সমাজে কিছু কুসংস্কার লক্ষ্য করা যায়। তাদের মধ্যে নিজ বংশের সাত পরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। তাদের সমাজে অন্তঃবিবাহ ও বহিঃবিবাহ প্রচলিত। চাকমা সমাজে বহু স্ত্রী বিবাহ এবং বিধবা বিবাহ অনুমােদিত।

(৯) বিবাহ বিচ্ছেদঃ চাকমা সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ কদাচিৎ ঘটে। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য গ্রাম্য সালিশ ডাকতে হয়।

(১০) চাকমাদের পােশাক পরিচ্ছদঃ চাকমা পুরুষদের পােশাক হলাে ধুতি, কোট, কখনও মাথায় পাগড়ি। মেয়েরা সাধারণত কোমর থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত স্কার্ট, বুকে ব্রেস্ট ক্লোথ এবং মাথায় সাদা শিরস্ত্রাণ পরিধান করে।

(১১) চাকমাদের উৎসবঃ বিজু ও মর্দারের পানাথার চাকমাদের প্রধান উৎসব। এ ছাড়া বিভিন্ন উদ্দেশ্যসাধনের জন্য চাকমারা ঈশ্বরের পূজা করে থাকে।

(১২) নেতৃত্বঃ চাকমা সমাজে আদমের নেতৃত্বে কারবারী, গ্রামের নেতৃত্বে হেডম্যান ও চাকমা সার্কেলের নেতৃত্বে থাকেন রাজা।

(১৩) শিক্ষাঃ অন্যান্য উপজাতির তুলনায় চাকমারা বেশি শিক্ষিত। তারা বাংলা ও ইংরেজিতে শিক্ষা গ্রহণ করছে। ফলে আজকাল বহু চাকমা সরকারি উচ্চপদে নিয়ােজিত।

(১৪) চাকমা অর্থনীতিঃ ঐতিহ্যগতভাবে চাকমারা জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। তারা বর্তমানে ব্যক্তি মালিকানায় হাল-চাষ পদ্ধতি শিখছে। তারা রাবার ওক কাঠের গাছের চাষ করে। সমতল নিম্ন ভূমিতে ধান চাষ করা হয়। তাদের অনেকেই মােরগ, মুরগী ও শুকর পালন করে।

(১৫) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াঃ চাকমা সমাজে মৃতদেহ পােড়ানাে হয়। তবে বুধবারে মৃতদেহ পােড়ানাে নিষিদ্ধ। সাত বছরের কম বয়সীদের কবর দেয়া হয়। মৃত্যুর সাতদিন পর সাতদিন্যা নামক একটি অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এ অনষ্ঠানে মদ, খাদ্য প্রভৃতি দ্রব্য মৃতের আত্মার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, চাকমারা অন্যান্য উপজাতি থেকে শিক্ষা, জীবন জীবিকা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছে। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায় যে, কিছু বাঙালি সংস্কৃতি চাকমা সংস্কৃতিতে মিশে যাচ্ছে। যেমন সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিন্দু প্রথার অনুরূপ বাংলা ও ইংরেজিতে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ। বলা যায় চাকমা সমাজে যথেষ্ট সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক