প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি কী? বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ গবেষণায় এর গুরুত্ব আলােচনা কর


প্রশ্নঃ প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ গবেষণায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির গুরুত্ব আলােচনা কর।

অথবা, প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি বলতে কী বুঝ গবেষণায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ আর্থসামাজিক তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পর্যবেক্ষণ। এর সাহায্যে যেকোনাে ব্যক্তি, একদল লােক এবং যে পরিবেশে তারা বাস করে এতদসম্পর্কে একটি সঠিক নিরীক্ষণ ও ঘটনা নথিভুক্ত করা যায়। সমসাময়িক জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করার বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে পর্যবেক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। যাকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের একটি প্রাথমিক হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হয়। মূলত সমস্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিই হলাে পর্যবেক্ষণ।

পর্যবেক্ষণ-এর সংজ্ঞাঃ P.V Young পর্যবেক্ষণের সংজ্ঞায় বলেন, "Observation may be defined as systematic viewing, coupled with consideration of seen phenomena" (অর্থাৎ দৃশ্যমান ঘটনা বা বিষয়কে সুশৃঙখলাভাবে নিরীক্ষণ করাই হলাে পর্যবেক্ষণ)

অন্যদিকে Concise Oxford Dictionary আরাে বিস্তৃতভাবে Observation-এর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের মতে, "Accurate watching, noting of phenomena as they occur in nature with regard to cause and effect and mutual relationship." (পারস্পরিক সম্পর্ক ও কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে সংঘটিত ঘটনাবলি সঠিকভাবে দর্শন এবং ধারণ)।

পর্যবেক্ষণের প্রকারভেদঃ নিম্নে এগুলাে সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে আলােচনা করে প্রশ্নমতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হলাে-

নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণঃ পরীক্ষণ প্রক্রিয়া সংবলিত পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ পরিচালিত হয়। ইদানীং সামাজিক ঘটনাবলি সংক্রান্ত পরিমাপযােগ্য তথ্য সংগ্রহ অনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির উন্নতির প্রতি গুরুত্বারােপ করা হয়েছে। পরিমাপযােগ্য তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে পর্যবেক্ষণ কার্যে শব্দ ধারণযন্ত্র, গতিবিধি লিপিবদ্ধকারক যন্ত্র, চলচ্চিত্র, পর্যবেক্ষণ অনুসূচি ও অন্যান্য আধুনিক পরিমাপক যন্ত্রপাতির সাহায্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে। শিশুদের ব্যবহার পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ অধিক প্রয়ােগ করা হয়। এই পদ্ধতিতে একটি কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করে সেই পরিবেশে। মানুষ কীভাবে আচরণ করে তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। মানুষের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না এবং পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণঃ এই পদ্ধতিতে কোনাে কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি না করে স্বাভাবিক পরিবেশেই পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ অর্থাৎ সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং অংশগ্রহণ ব্যতিত উভয় পদ্ধতিতেই অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ করা যায়।

কাঠামােবদ্ধ পর্যবেক্ষণঃ কাঠামােবদ্ধ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি সাধারণত কার্যকারণ সম্পর্কিত অনুমান যাচাই বা সুশৃঙ্খল বর্ণনা দান করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত গবেষণায় ব্যবহার করা হয়। অসংগঠিত পর্যবেক্ষণ থেকে এর পার্থক্য এই যে, এ ক্ষেত্রে গবেষক গবেষণার উদ্দেশ্য, পরিধি, আবশ্যকীয় তথ্য ইত্যাদি সম্পর্কে অধিকতর সচেতন এবং পর্যবেক্ষণের পূর্বেই তিনি সংগৃহীত তথ্য সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বাস্তব জীবন অথবা সুনিয়ন্ত্রিত গবেষণার যে স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হােক না কেন সংগঠিত পর্যবেক্ষণ মূলত সুনির্দিষ্ট ঘটনা, বিষয় বা আচার-আচরণের ওপরই কেন্দ্রীভূত থাকে।

অকাঠামােবদ্ধ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিঃ মূলত এ পদ্ধতি সামাজিক নৃতত্ত্বের অবদান। সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণই সাধারণত অসংগঠিত পর্যবেক্ষণের পর্যায়ভুক্ত। এই পদ্ধতিতে গবেষক যে দল বা শ্রেণিকে পর্যবেক্ষণ করবেন তাদের সাথে কিছুদিন অবস্থান করেন কিংবা তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেন এবং উক্ত দল বা শ্রেণি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করেন। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি প্রয়ােজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে থাকে।

অংশগ্রহণহীন পর্যবেক্ষণঃ পর্যবেক্ষণীয়দের কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কোনাে প্রকার অভিজ্ঞতা ছাড়াই পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকে যখন কোনাে বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষক এবং ধারণকারীর ভূমিকা গৃহীত হয় তখন তাকে অংশগ্রহণহীন পর্যবেক্ষণ বলে।

প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণঃ আলােচ্য প্রশ্নানুযায়ী এই ধরনটি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হল। গবেষকের অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ বিভিন্নভাবে হতে পারে। পর্যবেক্ষণীয় ঘটনা মধ্যস্থ একজন সদস্য হতে শুরু করে ঘটনা সম্পর্কে বহিস্থ তথ্য সংগ্রহকারি পর্যন্ত গবেষকের অংশগ্রহণের মাত্রা বিস্তৃত থাকতে পারে। গবেষক যখন সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেন তাকে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ বলে।

প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের সংজ্ঞাঃ A. B Blaclock এবং H. M Blaclock এর ভাষায়, ‘যখন একজন গবেষক পর্যবেক্ষণাধীন জনসমষ্টির পূর্ণ বিশ্বস্ততা অর্জন করেন, তার উপস্থিতি জনগােত সাধারণ কর্মতৎপরতায় কোন বাধার সৃষ্টি করে না, জনগণ যখন তার যেকোনাে তৎপরতার প্রতি স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিক্রিয়া করে এবং কোনাে তৎপরতা তার কাছে গােপন করে না তখন তিনি একজন অংশগ্রহণকারি পর্যবেক্ষক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন। বহু নৃ-তাত্ত্বিক গবেষক এ ধরনের অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের ফলশ্রুতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।”

T.S Wilkinson ও Bhandarkar অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের সংজ্ঞায় বলেন- অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ হলাে পর্যবেক্ষককে দলসদস্যে পরিণত করে পর্যবেক্ষক এবং পর্যবেক্ষণাধীন বিষয় উভয়কে একত্রে রাখার একটি প্রচেষ্টা, যেখানে পর্যবেক্ষণ সম্পর্কের কাঠামােতে পর্যবেক্ষণাধীন অনুভূতি ও কাজ সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়।

পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ কৌশল পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির এক কৌশল। যদিও এর কিছু সমস্যা রয়েছে। বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যদি সামাজিক সমস্যাগুলাে দূর করা যায়, তাহলে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আরও জনপ্রিয়তা লাভ করবে এই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক