সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলােচনা কর


প্রশ্নঃ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলােচনা কর।
অথবা, একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের স্বরূপ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সমাজবিজ্ঞান একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। মানবসভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে শেখে। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। যে মানুষ সমাজে বাস করে না, সে হয় দেবতা না হয় পশু। তাই সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ প্রথম থেকেই সমাজকে জানতে চেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৩৯ সালে আগস্ট কোঁৎ সর্বপ্রথম সমাজ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেন এবং সমাজবিজ্ঞানের জন্ম দেন।

সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতিঃ সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞার মধ্যেই সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি নিহিত। সমাজবিজ্ঞানের মূল আলােচ্য বিষয় সমাজ; ব্যক্তি নয়। তবু যেহেতু ব্যক্তি নিয়েই সমাজ তাই সমাজকে জানতে হলে ব্যক্তিকে জানা অপরিহার্য। সমাজ বলতে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সংঘ, সম্প্রদায়, দল ইত্যাদির সমন্বিত রূপকে বুঝায়। প্রকৃতি শব্দের অর্থ স্বভাব বা চরিত্র। নিম্নে সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি তুলে ধরা হলাে-

(১) পূর্ণাঙ্গ পাঠঃ সমাজবিজ্ঞান সমাজের পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন। বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞান যেখানে সমাজের এক একটা বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করে, সেখানে সমাজবিজ্ঞান গােটা সমাজকে নিয়ে অখণ্ড আলােচনা করে।

(২) সমাজের কাঠামােগত দিকঃ সমাজবিজ্ঞান সমাজের কাঠামােগত উপাদান এবং গঠনপ্রণালি নিয়ে আলােচনা করে। মানবসম্পর্ক হলাে সমাজকাঠামাের ভিত্তি। আর তাই সমাজবিজ্ঞান ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, ব্যক্তির সাথে গােষ্ঠীর কিংবা ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক আলােচনা করে।

(৩) বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ দানঃ সমাজবিজ্ঞান সমাজকাঠামাের যুক্তিপূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা দান করে। মানুষের সামাজিক সম্পর্কগুলাে যুক্তিহীন, বিচ্ছিন্ন বা অনর্থক নয়। সমাজবিজ্ঞান যুক্তির প্রাধান্য দেয় এবং কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করে যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ দান করে।

(৫) প্রায়ােগিক বিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞান একটি প্রায়ােগিক বিজ্ঞান। সমাজস্থ মানুষের আচরণ, বিধি ও কার্যাবলি কীভাবে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং কিভাবে এর চলমান প্রক্রিয়া বজায় থাকে তা নিয়ে আলােচনা করার জন্য সমগ্র সমাজের মধ্যে অনুসন্ধান করতে হয়। সমাজবিজ্ঞান এ অনুসন্ধান কাজে তার বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়ােগ করে থাকে।

(৬) নিরপেক্ষ বিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞান সমাজের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ হওয়া সত্বেও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। সমাজে বসবাসরত মানুষদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব না করে বরং নিরপক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে। নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এ বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান প্রত্যয়।

(৭) সামাজিক বিষয়াবলীর অধ্যয়নঃ সমাজবিজ্ঞান সমাজের গতিশীলতা, স্থিতিশীলতা, সামাজিক সংগঠন, সামাজিক অসমতা, বিশ্বায়ণ, নগরায়ণ, নাগরিক জীবনসহ সকল সামাজিক বিষয়াবলির বিজ্ঞানভিত্তিক অধ্যয়নের পথ প্রদর্শন করে। সামাজিক বিষয়াবলীর যথাযথ অধ্যয়নের মাধ্যমে নাগরিকগণ সচেতন নাগরিক পরিণত হয়।

(৮) গতিশীল বিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞানগুলাের মধ্যে অন্যতম প্রধান গতিশীল বিজ্ঞান হিসেবে পরিচিত। কারণ সমাজবিজ্ঞান সমাজকে নিয়ে আলােচনা করে। আর মানবসমাজ সবসময় গতিশীল। তাই সমাজবিজ্ঞান মানব সমাজের গতিশীল বিষয়সমূহের আলোচনার করার কারণে একটি গতিশীল বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

(৯) বস্তুবাচক নয়, বিমূর্ত বিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞান একটি বিমূর্ত বিজ্ঞান। এটি বস্তুগত বিজ্ঞান নয়। সুতরাং সমাজবিজ্ঞান যেসব বিষয় নিয়ে আবর্তিত হয় তার কোনােটিই বস্তুবাচক নয়, সবই বিমূর্ত প্রত্যয়। যেমনঃ সমাজ, সম্প্রদায়, দল, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

(১০) সামাজিক আচরণ বিশ্লেষণঃ সমাজ হচ্ছে অসংখ্য মানুষের সমষ্টি, যেখানে বিভিন্ন ধরনের আচরণের সমন্বয় দেখা যায়। বিভিন্ন বর্ণ ও গােত্রের মানুষ তাদের নিজেদের তৈরি আচরণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। আর সমাজবিজ্ঞান সমাজের সকল মানুষের আচরণগত পার্থক্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি সমন্বয়সাধন করে। যার ফলে আমরা পরস্পরে আচরণগত সম্পর্কে অবগত হই।

(১১) স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞান এমন একটি বিজ্ঞান যা অন্যান্য বিজ্ঞান থেকে আলাদা। এর রয়েছে নিজস্ব বিশেষ অধ্যায়ণ পদ্ধতি, গবেষণা পদ্ধতি, বস্তুগত বিশ্লেষণ, বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা, যা এটিকে অন্যান্য বিজ্ঞান থেকে স্বতন্ত্রতা দান করেছে। সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের জন্য সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সময়ে উদ্ভুত সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃত্ত্বিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও বিশ্লেষণে সমাজবিজ্ঞান ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

(১২) সামাজিক কাঠামাে বিশ্লেষণঃ প্রত্যেকটা সমাজেরই একটা তাত্ত্বিক কাঠামাে থাকে। যা ঐ সমাজ ব্যাবস্থার ভিত্তি স্বরূপ। প্রত্যেকটি সমাজেরই সমাজ কাঠামাে তাদের মৌলিক সম্পদ। আর সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর সমাজ কাঠামাের বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রদান করে। যার ফলে আমরা বিভিন্ন জাতি গােষ্ঠীর সামাজিক কাঠামাে সম্পর্কে অবগত হতে পারি।

(১৩) যুক্তিনিষ্ঠ ও বিজ্ঞান-ভিত্তিক অধ্যায়ণঃ সমাজবিজ্ঞান সমাজ, সভ্যতা, সমাজ কাঠামাে, সামাজিক অসমতা, সামাজিক স্তর বিন্যাস, দারিদ্র্য, সামাজিক গতিশীলতা, গােষ্ঠীগত আচরণ, সমাজের গঠন প্রণালী, নৈতিক আচরণাবলি ইত্যাদির যুক্তিনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এসকল বিষয়কে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরে।

(১৪) সামাজিক পরিকল্পনার বিশ্লেষণঃ সমাজবিজ্ঞান সামাজিক পরিকল্পনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণনির্ভর বিজ্ঞান। এটি সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্য, পদ্ধতি নির্ধারণ, সম্ভাব্য ফলাফল, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপায় প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে থাকে। এ ছাড়া সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নে গৃহীত বহুবিধ পরিকল্পনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও এর প্রধান কাজ।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞান হলাে সমাজ সম্পর্কিত বিজ্ঞানভিত্তিক বা বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়ন। ব্যক্তি এবং সমাজজীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র এতে স্থান পেয়েছে, তাই এর প্রকৃতি অত্যন্ত ব্যাপক। সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় তথা মানুষের যাবতীয় মানবীয় আচরণ সম্পর্কে জানতে হলে সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক