বর্তমানে কী কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হচ্ছে বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ বর্তমানে কী কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হচ্ছে বর্ণনা কর।
অথবা, সাম্প্রতিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্মান ও ক্ষমতার জীব। গুণ-ক্ষমতা ও যােগ্যতার প্রেক্ষিতে মানুষ বিচিত্র এবং পরস্পর নির্ভরশীল। মূলত এ কারণে মানুষ বাঞ্ছিত জীবনযাপনের প্রত্যাশায় সমাজ গঠন করে। আর এই সমাজকে সুষ্ঠু সামঞ্জস্যশীল উপায়ে পরিচালনার মাধ্যমে শান্তি-শৃঙ্খলা, ঐক্য, সংরক্ষণ ও বিকাশ ধারা প্রবর্তনের জন্য গঠন করা হয় রাষ্ট্র। তাই সহজ কথায় বলতে গেলে, যে বিজ্ঞান রাষ্ট্র নিয়ে আলােচনা করে তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান।

বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হওয়ার কারণসমূহঃ বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হওয়ার কারণসমূহ নিয়ে আলােচনা করা হলাে-

(১) তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নঃ সাম্প্রতিককালে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দুই বা ততােধিক দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধ্যয়ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। এই তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলাে চিহ্নিত করা যায়।

(২) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নঃ সমগ্র পৃথিবীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলােচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সংগঠন, কূটনীতি, জাতীয়তাবাদ, প্রতিরক্ষার সাথে সম্পর্কিত ব্যাপক সমস্যা প্রভৃতি সব কিছুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গভীরভাবে বিশ্লেষিত হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হচ্ছে।

(৩) আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রভাবঃ বর্তমান যুগ আন্তর্জাতিকতার যুগ। তাই রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক রীতি নীতি নিরপেক্ষ হতে পারে না। বর্তমানকালে নাগরিক ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বহুবিধ বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ জাতীয় জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রীতিনীতি স্বাভাবিকভাবে এসে পড়ে।

(8) নৈতিক ও আর্থিক বিষয়ের সংযােজনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল বিজ্ঞান। এর আলােচনা ক্ষেত্রের পরিধি ক্রমেই ব্যাপকতর হচ্ছে। রাষ্ট্রের কার্যক্রম নির্ধারিত হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা কেবল রাষ্ট্রের আলােচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সুতরাং সমাজের নৈতিক এবং আর্থিক বিষয়য়াদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় এসে যায়।

(৫) আর্থসামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধিঃ আধুনিক বিশ্ব হচ্ছে প্রতিযােগিতামূলক বিশ্ব। তাই বর্তমান বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও প্রতিযােগিতা বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় আর্থ-সামাজিক গতিশীলতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এসব বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধিকে প্রসারিত করেছে।

(৬) নতুন নতুন তত্ত্ব অন্তর্ভূক্তঃ আধুনিককালে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও আঞ্চলিক সহযােগিতা সংস্থা প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নতুন নতুন তত্ত্ব যুক্ত হচ্ছে। ফলে এর পরিধি প্রসারিত হচ্ছে। এই সমস্ত নতুন নতুন তত্ত্বে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সংযােজিত হচ্ছে।

(৭) তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও নতুন নতুন বিষয় রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্তঃ তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলে মানুষের বহুমুখী চাহিদা পূরণ হচ্ছে। দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হচ্ছে।

(৮) রাষ্ট্রসম্পর্কিত আলােচনাঃ বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার বিষয়বস্তু ও পরিধি সম্প্রসারিত হচ্ছে। কেননা অতীতে শুধুমাত্র রাষ্ট্রসম্পর্কিত আলােচনার মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যাবলি ও তার উপযুক্ত সমাধানও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলােচিত হচ্ছে।

(৯) রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণার বিবর্তনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ধারণা তার আলােচনাক্ষেত্রের পরিধি দ্বারাই নির্ধারিত হয়। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানও একটি গতিশীল বিজ্ঞান। মানুষের সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবির্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার পরিধিও পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত হয়েছে।

(১০) উদ্দেশ্যমূলক আলােচনাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবল অতীত ও বর্তমানকে নিয়ে আলােচনা করে না। অতীত ও বর্তমানের আলােচনার আলােকে রাষ্ট্রীয় জীবনের-গতিপথ নির্ধারণেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাহায্য করে। এই কারণে Gettell বলেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকারের অতীতের আলােচনা ও বর্তমানের সমালােচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইঙ্গিত প্রদান করে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হচ্ছে।

(১১) কার্যপরিধির নতুন মাত্রাঃ বর্তমানে রাষ্ট্রের কার্যপরিধিতে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। বর্তমানে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানাকারণে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়ে বিশ্বশান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। এমতাবস্থায় অপরাপর রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসে সংঘর্ষ সমাধানের চেষ্টা করে।

(১২) কল্যাণকর কার্যসাধনঃ রাজনীতিশাস্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াবলি যথা শিশুশ্রম বন্ধকরণ, সন্ত্রাস নির্মূল, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কল্যাণকর কার্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সম্পন্ন করা হয়। ফলে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পরিবর্তনশীল মানবসমাজের ব্যাপক ও বহুমুখী বিস্তার এবং বিভিন্ন সমস্যার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও সঠিক সমাধান সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলােচনা করা হয়। বর্তমানে নিত্য-নতুন গবেষণা ও সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান সহযােগিতার ফলে আলােচ্য শাস্ত্রটির আলােচনার পরিধি বিশেষভাবে প্রসারিত ও জটিল হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক