সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর


প্রশ্নঃ সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়সমূহের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। যে চারটি উপাদানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র গঠিত, তাদের মধ্যে সার্বভৌমত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য উপাদান। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও স্বরূপ বহুলাংশে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃতি ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। সার্বভৌমত্বকে বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের মৌলিক গুণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ফরাসি লেখক জৗ রােদা সর্বপ্রথম ১৫৭৬ সালে সার্বভৌমতু কথাটি ব্যবহার করেন। সার্বভৌমত্ব ধারণাটি প্রথম হতেই আইনগত প্রাধান্য লাভ করেছে।

সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যঃ সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা ও স্বরূপ সম্পর্কিত আলােচনার বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নলিখিত কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিগােচর হয়। এই বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমত্বের ধারণাটি সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা সম্ভবপর নয়। আইনবিদদের মতানুসারে, এগুলাে হলাে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের চূড়ান্ত লক্ষণ।

(১) মৌলিকত্বঃ সার্বভৌমত্ব হলাে রাষ্ট্রের মৌলিক ক্ষমতা। সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক। সকল ক্ষমতা সার্বভৌম ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এই অপর কোনাে শক্তির ওপর নির্ভরশীল হতে হয় না। এ ক্ষমতা মৌলিক ও অকৃত্রিম। E.C. Ewing-এর মতে, রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব হলাে সার্বভৌমত্ব।

(২) চরমত্বঃ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা হল চরম, নিরংকুশ ও সীমাহীন। অন্তর ও বাইরের কোনাে শক্তির নির্দেশে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় না। এই ক্ষমতা অপরের দান হিসেবেও আসে না, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের সব শক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র প্রণীত আইনকে কোনােভাবেই অস্বীকার করতে বা অবজ্ঞা করতে পারে না। রাষ্ট্রপ্রণীত আইনভঙ্গ করলে আইনভঙ্গকারীকে কঠোর শাস্তি পেতে হয়।

(৩) স্থায়িত্বঃ স্থায়িত্ব হল সার্বভৌমত্বের একটি বৈশিষ্ট্য। সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্বের প্রশ্নটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। রাষ্ট্র যতদিন টিকে থাকে সার্বভৌমত্বও ততদিন টিকে থাকে। স্থায়িত্ব হলাে রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্বের উভয়েরই বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রের বিলুপ্তিতেই এই ক্ষমতার বিনাশ ঘটে। নতুবা সরকারের উত্থান-পতন সত্ত্বেও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকে।

(৪) অবিভাজ্যতাঃ অবিভাজ্যতা সার্বভৌমত্বের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সার্বভৌম এক ও অবিভাজ্য। ঐক্যবদ্ধ জনসমাজের চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতেই ন্যস্ত। রাষ্ট্রাধীন বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন সম্ভব হতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্ব বণ্টন সম্ভবপর নয়। এই চরম ক্ষমতা ভাগাভাগি এক বিলপ্তির শামিল।

(৫) সর্বজনীনতাঃ সার্বভৌম ক্ষমতা সর্বজনীন ও ব্যাপক এটা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল ব্যক্তি ও সংস্থার ওপর পরিব্যাপ্ত। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এমন কোনাে ব্যক্তি বা সংস্থা নেই যা সার্বভৌম শক্তির অধীন নয়। রাষ্ট্রকে আইন প্রণয়ন করে তা তার এলাকার অন্তর্ভুক্ত সকল ব্যক্তি ও সংস্থার ওপর পরিব্যাপ্ত। এই আইনকে কেউ অমান্য করতে পারে না। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা যায় রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে নিযুক্ত বৈদেশিক দূতাবাসসমূহের ক্ষেত্রে।

(৬) হস্তান্তরের অযােগ্যঃ সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। একে হস্তান্তর করা যায় না। চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতা কখনও হস্তান্তর করা যায় না। মানুষ যেমন তার প্রাণ অন্যকে দান করতে পারে না, নদী যেমন তার উচ্ছল জলরাশির গতি রুদ্ধ করতে পারে না, তেমনি রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতা পরিত্যাগ করতে পারে না। এর ওপরই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নির্ভরশীল।

(৭) এককত্বঃ এককত্ব সার্বভৌমত্বের অপর একটি বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রের কেবলমাত্র একটি সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। অর্থাৎ সার্বভৌম ক্ষমতা এক ও অনন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সার্বভৌম ক্ষমতা অপেক্ষা অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন। কোনাে শক্তি থাকতে পারে না। একাধিক ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত হলে রাষ্ট্রের ঐক্য, স্থায়িত্ব, সংহতি বিনষ্ট হয়।

(৮) অনন্যতাঃ সার্বভৌম ক্ষমতা অনন্য। এ ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রের হাতেই ন্যস্ত থাকে। রাষ্ট্র ছাড়া অন্যকোনাে প্রতিষ্ঠান সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। Prof. Mobbot বলেন, অনন্যতা সার্বভৌমত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অলংকার মানুষের শরীরের যেমন সৌন্দর্য বাড়ায় তেমনি অনন্যতা সার্বভৌমত্বের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।

(৯) অত্যাবশ্যকতাঃ অত্যাবশ্যকতা সার্বভৌমত্বের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বা উপাদান। সার্বভৌমত্ব ছাড়া রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। সার্বভৌমত্ব যতদিন থাকবে রাষ্ট্র ততােদিন থাকবে। সার্বভৌমত্ব তখনই বাস্তবায়িত হয় যখন একটি রাষ্ট্রের প্রয়ােজনে ব্যবহার করা হয়।

(১০) আইনসম্মতঃ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা আইনের দ্বারা অনুমােদিত। এ ক্ষমতাই আইন হিসেবে কাজ করে। যে কেউ বা যেকোন প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করলেই এ ক্ষমতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কেউ সার্বভৌম আইন অমান্য করলে তাকে শাস্তি পেতে হয়।

(১১) বিনাশহীনঃ রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণের মতে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার বিনাশ নেই। তারা সার্বভৌম ক্ষমতাকে অবিনশ্বর হিসেবে স্বীকার করেছেন। রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণের মতে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার বিনাশ হলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে না।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, একটি প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র কিনা তা যাচাইয়ের কষ্টিপাথররূপে বিবেচিত হয় সার্বভৌমত্ব। যে সব প্রতিষ্ঠানে এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির অস্তিত্ব নেই, তা কোনােক্রমেই রাষ্ট্র বলে গণ্য হতে পারে না। সার্বভৌমত্বের সাহায্যে রাষ্ট্রকে অন্যান্য সংঘ, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হতে সহজেই পৃথক করা যায় । অধ্যাপক গেটেল তাই যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘সার্বভৌমত্বের ধারণাই হলাে আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি’।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক