অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের গুরুত্ব আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের জীবন ও সমাজ গতিশীল। এর বিবর্তন ঘটেছে ও ঘটবে। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে মানুষ কতগুলাে নিয়ম-কানুন মেনে চলে। এই সমস্ত নিয়ম-কানুনের এক বিশেষ উন্নত প্রকাশ হলাে রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদি। মানুষের সংঘবদ্ধ জীবনের চরম অভিব্যক্তি হলাে রাষ্ট্রশক্তি। তাই যে শাস্ত্র রাষ্ট্রের তত্ত্ব, সংগঠন, শাসনপ্রণালী ও অন্যান্য কার্যাবলী নিয়ে আলােচনা করে, তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলা হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তাঃ সমাজজীবনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার প্রেক্ষাপটেই সমাজজীবনের প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করা যায়। মানুষের রাজনৈতিক জীবনের এই গুরুত্বের কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তা নিম্নে আলােচিত হলাে-
(১) রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিঃ রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করা অত্যন্ত প্রয়ােজন। কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অধিকতর সচেতন হতে সাহায্য করে। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করলে ব্যক্তির রাজনৈতিক সচেতনতা অধিকতর হারে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ব্যক্তিত্ব সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে সচেতন হয়ে। রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে।
(২) বিভিন্ন মনীষীদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে ধ্যান-ধারণাঃ বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মনীষীগণ পৃথক-পৃথকভাবে রাষ্ট্রকে নিয়ে চিন্তা করেছেন। যেমন-প্লেটো, এরিস্টটল, সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট টমাস, একুইনাস, ম্যাকিয়াভেলি, হস, লক, রুশাে প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করতে হবে।
(৩) রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনঃ রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আমাদের জ্ঞান দান করে। জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করা প্রয়ােজন।
(৪) ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্যঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে ব্যক্তি তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং রাষ্ট্রপ্রদত্ত অধিকারগুলাের সদ্ব্যবহার করে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে। কারণ ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের কখন কী করা দরকার, তাদের অধিকার ও কর্তব্য কী এগুলাে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমেই কেবল জানা সম্ভব। এভাবে সচেতন নাগরিক হওয়া যায়।
(৫) গণতন্ত্রের বিকাশঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে ব্যক্তি সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত গণতন্ত্র সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে এবং সমাজের সর্বস্তরে তা চালু করতে পারে। রাষ্ট্রের মানুষের অধিকার ও কর্তব্য, গণতান্ত্রিক মূল্যবােধগুলাে চর্চার উপায় ইত্যাদি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানই বিস্তারিত আলােচনা করে। তাই গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে এগুলাের অধ্যয়ন অতীব প্রয়ােজন।
(৬) সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যেঃ সুসংগঠিত সমাজের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলােচনা করা হয়। কাজেই সুন্দর, সুসংগঠিত ও সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে হবে। সুন্দর ও সুসংগঠিত সমাজ গঠন সমাজের প্রত্যেকেই চায়। এজন্য প্রয়ােজন এ ধরনের সমাজ গঠনের জন্য সচেতনতা ও তা গঠনের কৌশল সম্পর্কে নাগরিক জ্ঞান।
(৭) রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনঃ সরকার, জনমত, নির্বাচকমণ্ডলী, রাজনৈতিক দল ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা প্রয়ােজন। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে গােটাবিশ্বের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ নাগরিকের প্রয়ােজন। আর এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের বিকল্প নেই।
(৮) নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগারঃ রাষ্ট্র বিজ্ঞানে নেতৃত্ব কী, নেতা কী, একজন ভালাে নেতার বৈশিষ্ট্য কী কীভাবে নেতৃত্ব তৈরি হয় ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করে। যার ফলে যােগ্য নেতৃত্বের ধারণা স্পষ্ট হয়। তাই বলা হয় রাষ্ট্র পরিচালনা ও যােগ্য নেতৃত্ব গঠনে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
(৯) রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানই একমাত্র বিজ্ঞান যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার মাধ্যমে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে সম্যক ধারণা দান করে। যা রাজনৈতিক সচেতনতা ও ঐতিহ্যকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়।
(১০) অধিকার ও কর্তব্যের প্রাথমিক ধারণা প্রদানঃ নাগরিক ও সুনাগরিক কী, সুনাগরিকের গুনাবলী কী কী। সুনাগরিকের অন্তরায় কী, রাষ্ট্রের প্রতি একজন নাগরিকের দায়িত্ব কী কী এবং রাষ্ট্র নাগরিককে কী কী অধিকার প্রদান করবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিস্তৃতভাবে আলােচনা করে। ফলে নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কিত জ্ঞানের ধারণা স্পষ্ট হয়।
(১১) সরকারের বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনঃ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন নামে সরকারের তিনটি প্রধান বিভাগ বিদ্যমান। যথা- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের মাধমে সরকারের। এসব বিভাগ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা যায়। সুতরাং সরকারের বিভাগ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ অত্যাবশ্যক।
(১২) সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত গ্রহনঃ সরকারের গৃহীত নীতি ও কার্যক্রম এবং তার সম্ভাব্য ফলাফল, নির্বাচিত প্রতিনিধির চরিত্র প্রভৃতি সবকিছুই আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য জানা আবশ্যক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে এমন সব তথ্য, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান লাভ করা যায়, যা একজন নাগরিককে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে থাকে।
(১৩) কুসংস্কার দূরীকরণঃ একটি রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণার্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। সুশাসন কী এবং কীভাবে তা নিশ্চত করা যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
(১৪) তরুন সমাজকে সচেতনতা বৃদ্ধি করাঃ আগামী দিনের নাগরিকদের ওপরই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। তাই গােটা বিশ্বের কল্যাণ সাধনের মানসে তরুণ সমাজকে অবশ্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞানার্জন করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে তরুণ সমাজ সচেতন হয়ে ওঠে। আর এ ধরণের তরুণ সমাজই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। কেননা যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের সভ্য নাগরিক হিসেবে নাগরিকগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের অধিকার, কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে পরিপক্ক জ্ঞান লাভ করতে পারবে না।
0 মন্তব্যসমূহ