‘দি রিপাবলিক' এ বর্ণিত প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামাে বা রূপরেখা চিত্রিত করেছেন- আলােচনা কর


প্রশ্নঃ ‘দি রিপাবলিক' এ বর্ণিত প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামাে বা রূপরেখা চিত্রিত করেছেন- আলােচনা কর।
অথবা, ‘দি রিপাবলিক' এ বর্ণিত প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামাে বা রূপরেখা চিত্রিত করেছেন- বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকাঃ বর্তমান সভ্যতার অগ্রগতি, শাসনব্যবস্থার সারল্য, গণতন্ত্রের আধুনিক জীবনধারার পূর্ণ বিকাশের মূলে Father of the political philosophy হিসেবে পরিচিত প্লেটোই সর্বপ্রথম মৌলিক ও সমন্বিত চিন্তাধারা প্রকাশ করেন। তার রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করা। এর জন্য তিনি Deductive বা Abstract method অবলম্বন করেন। তার রাষ্ট্র দর্শনের মূল ভিত্তি সক্রেটিস প্রদত্ত Virtue is knowledge নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের উন্নতি ও সৎ জীবন প্রতিষ্ঠা করা।

রাষ্ট্রের উৎপত্তিঃ একজন মানুষ যতই শক্তিশালী হােক না কেন, তার একার পক্ষে তার অফুরন্ত অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়। সে কারণে তাকে কোনাে কোন কাজের জন্য অন্য লােকের ওপর নির্ভর করতে হয়। যাকে বলা হয় Principle of reciprocity. পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাই হচ্ছে মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবনের উৎপত্তির প্রথম ও প্রধান কারণ এবং এসব নীতির মধ্যেই রাষ্ট্রীয় ঐক্যের মূল কারণ নিহিত।

প্লেটোর আদর্শ আদর্শ রাষ্ট্রঃ প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের উপস্থাপনের শুরুতেই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন 'The state is individual writ large.' কারণ মানব প্রকৃতিতে এমন কিছু রয়েছে, যা রাষ্ট্রের উপযােগী আবার রাষ্ট্রে এমন কিছু রয়েছে, যা সমাজের উপযােগী। এই উপযােগিতাকে তিনি সাদৃশ্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষ ও রাষ্ট্র এমন একটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যার ফলে একটির জন্য যা ভালাে, তা অন্যের জন্য ভালাে না হয়ে পারে না। যেমন মানুষের চেতনা ও রাষ্ট্রের চেতনা পৃথক করে দেখা যায় না। রাষ্ট্রের চেতনা হচ্ছে নাগরিকদেরই চেতনা, যখন তারা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে চিন্তা করে।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখাঃ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখায় আমরা যা দেখতে পাই তা হলাে-

(১) রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মাঝে সাদৃশ্যঃ প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র উপস্থাপনের শুরুতেই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন রাষ্ট্র ব্যক্তির বৃহত্তম সংরক্ষণ, কারণ মানব প্রকৃতিতে এমন কিছু রয়েছে যা রাষ্ট্রের উপযােগী, আবার রাষ্ট্রে এমন কিছু রয়েছে যা সমাজের উপযােগী। এই উপযযাগিতাকে তিনি সাদৃশ্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

(২) আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তিঃ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হলাে ন্যায়ধর্ম। অধ্যাপক সেবাইন বলেন, ন্যায় ধর্মের ভিত্তিতেই প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র অংকন করেন এবং একে সমাজ ও রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিশেষ শিক্ষাপদ্ধতি ও সাম্যবাদ প্রবর্তন করেন।

(৩) আদর্শ রাষ্ট্রে ব্যক্তির শ্রেণীবিভাগঃ প্লেটোর মতে মানবাত্মা তিনটি ভাগে বিভক্ত- সর্বোচ্চ অংশে রয়েছে যুক্তিবােধ, মাঝের অংশে সাহস এবং নিম্নাংশে রয়েছে ক্ষুধা। মানব মনের এই তিনটি প্রবণতাকে ভিত্তি করেই রাষ্ট্রে তিনটি শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এরা হলাে (ক) অভিভাবক শ্রেণী, (খ) সৈনিক শ্রেণী, (গ) উৎপাদক শ্ৰেণী।

(ক) অভিভাবক শ্রেণীঃ যারা যুক্তি ও প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত হয়ে রাষ্ট্রকে শাসন করবে এবং জনসাধারণের উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করবে তারাই হবে অভিভাবক শ্রেণী। এ অভিভাবক শ্রেণীর মধ্যেই প্লেটো তার দার্শনিক রাজার স্বপ্ন দেখেছেন। দার্শনিক রাজার হাতে রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। প্লেটোর মতে দার্শনিক রাজা হবেন জ্ঞান ও সত্য পিপাসু, ধৈৰ্য্যশীল, ভােগবিলাস মােহমুক্ত, উদার মনা ও কুসংস্কারমুক্ত।

(খ) সৈনিক শ্রেণীঃ যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে তারাই হবেন সৈনিক শ্রেণী। এরা বুকের সাহস দিয়ে প্রহরী কুকুরের মত বিশ্বস্ততা ও সতর্কতার সাথে দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক আক্রমণ ও গােলযােগ হতে দেশকে রক্ষা করবে। বাল্যকাল হতেই তাদেরকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তােলার প্রতি তিনি গুরুত্বারােপ করেন এবং যুদ্ধ ছাড়া তাদের অন্যকোনাে কাজ থাকবে না।

(গ) উৎপাদক শ্রেণীঃ রাষ্ট্র সূচারুরূপে পরিচালনা করতে ও রাষ্ট্রের মৌলিক চাহিদা মেটাতে প্রয়ােজন উৎপাদক শ্রেণীর। এরা দৈহিক পরিশ্রমের দ্বারা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতি পার্থিব প্রয়ােজন মেটানাের জন্য উৎপাদন, কার্যে নিয়ােজিত থাকবে। কারণ মৌলিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম হলে রাষ্ট্র ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য।

(৪) শিক্ষা ব্যবস্থাঃ প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রে অন্যতম শর্ত হিসেবে স্ত্রী-পুরুষ সকলের জন্য একই ধরনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন। তিনি শিক্ষাকে Theone great thing বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের নাগরিকগণ যদি শিক্ষিত হন, তাহলে সহজেই সকল সমস্যার সমাধান করা সম্ভবপর হবে।

(৫) সাম্যবাদঃ প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য অভিভাবক শ্রেণী অর্থাৎ সৈনিক ও দার্শনিক শাসকদের জন্য সম্পত্তি ও প্রচলিত পরিবার প্রথার উচ্ছেদ করে এক সাম্যবাদী শাসনের কথা উল্লেখ করেছেন। এর ফলে এটা আমার ওটা তােমার বলে কোনাে কথা থাকবেনা। তিনি বিশ্বাস করেন ব্যক্তিগত বিষয় সম্পত্তি ও পরিবারের চিন্তা-ভাবনা রাষ্ট্র কল্যাণে দায়িত্বশীলদের একাগ্রচিত্তের মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে।

পরিশেষঃ প্লেটোর দার্শনিক রাজা তত্ত্বের এবং আদর্শ রাষ্ট্রের যতই সমালােচনা করা হােক না কেন একটি কথা স্বীকার করে উপায় নেই যে, প্লেটোর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এর কোনাে সমালােচনাই ধােপে টেকে না। প্লেটো বাস্তব রাষ্ট্রের ত্রুটি-বিচ্যুতির ভিত্তিতে আদর্শ রাষ্ট্রের নকশা অঙ্কন করতে চেয়েছেন। কাজেই বাস্তব রাষ্ট্রের সঙ্গে তার আদর্শ রাষ্ট্রের সংঘর্ষ অনিবার্য। প্লেটো যে জ্ঞানসমৃদ্ধ অকৃত্রিম শাসকের কথা বলেছেন সত্যিকার সেরকম লােকের হাতে যদি শাসনভার অর্পণ করা যেত, তাহলে আজকের সমস্যা জর্জরিত রাষ্ট্রের অনেক সমস্যাই সৃষ্টি হতাে না। মানুষের মূল্যবােধের জগতে আজ যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃতপক্ষে দার্শনিক রাজার শাসন সম্ভবপর হলে এ সমস্যা সৃষ্টি হতাে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক