রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদসমূহ আলােচনা কর


প্রশ্নঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, “রাষ্ট্রের উৎপত্তি সামাজিক চুক্তির ফল” আলােচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও সামাজিক চুক্তির সম্পর্ক আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তিবিষয়ক একটি কাল্পনিক মতবাদ সামাজিক চুক্তি মতবাদ। নানা দিক দিয়ে এ মতবাদটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। মতবাদটি কেবল রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে না, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ধারণ ও রাষ্ট্রের প্রকৃতিও ব্যাখ্যা করে থাকে। সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব রাষ্ট্র সৃষ্টির মূলে মানুষের সচেতন প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং রাষ্ট্র চিন্তায় আধুনিকতার ধারা প্রবর্তন করেছে। তাই সামাজিক চুক্তি মতবাদকে অনেকে রাষ্ট্র সৃষ্টির উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের ধারণাঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্র কোন ঐশ্বরিক বা অমানবিক ব্যবস্থা নয়। এ ব্যবস্থাকে কেউ বলপূর্বক মানুষের উপর চাপিয়ে দেয় নি। মানুষ স্বতঃপ্রণােদিত হয়েই রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এ মতবাদের সমর্থকদের মতে, সুদূর অতীতে মানুষ এ রাষ্ট্রহীন অবস্থায় বসবাস করতাে। রাষ্ট্রহীন এ অতীত অবস্থাকে বলা হয় প্রাকৃতিক অবস্থা। মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতাে। মানুষের এ স্বাধীনতার উপর একমাত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক আইনের। নানা কারণে প্রাকৃতিক অবস্থা অসহনীয় হয়ে উঠে। এ রকম অবস্থায় মানুষ স্বেচ্ছায় প্রাকৃতিক অবস্থার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমর্থকঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমর্থক হলেন ব্রিটেনের টমাস হবস, জন, লক, ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশাে। এ ব্যাপারে তিনজনই একমত পােষণ করেন যে, প্রকৃতির রাজ্যের অবস্থার হাত থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে।

হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ হবসের মতানুসারে মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থার অরাজকতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য চুক্তি করেছে। এ চুক্তি অনুসারে এক পর্যায়ে জনগণ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। জনসাধারণই হলাে একমাত্র পক্ষ। প্রাকৃতিক পরিবেশে আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সকল অধিকার ও শাসন করার ক্ষমতা নিঃশর্তভাবে একজন বা কয়েকজন শাসকের হাতে অর্পণ করেছে। শাসক বা রাজশক্তি সবকিছুর উর্ধ্বে। রাজা হলেন সর্বশক্তিমান ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সার্বভৌম, তার আদেশই হলাে আইন। রাষ্ট্রের আইনের দ্বারা প্রজাসাধারণের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ। সুতরাং রাষ্ট্র হলাে চরম ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তিবর্গকে অনুগত থাকতে হয়। রাষ্ট্র বা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার জনগণের নেই।

জন লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ ইংরেজ দার্শনিক জন লক ১৬৯০ সালে 'Two Treatise on Civil Government' নামক গ্রন্থে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি ব্যাখ্যা করেন। তার মতানুসারে, প্রাক রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক অবস্থায় জনগণ কিছ অধিকার ভােগ করতাে। তারা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে এসব অধিকারের কিছু অংশ শাসকের হাতে প্রদান করেছে। শাসক বা রাজা জনসাধারণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং পরিবর্তে জনসাধারণ আনুগত্য প্রদর্শন করবে। শাসক যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তির শর্ত পূরণ করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি শাসনক্ষমতা ভােগ করবেন। শাসক চক্তি ভঙ্গ করলে বা চুক্তির শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে, জনসাধারণ শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবেন। এ চুক্তিকে সামাজিক চুক্তি বলা হয়ে থাকে।

রুশাের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ ফরাসি দার্শনিক, রুশাে ১৭৬২ সালে 'The Social Contract' গ্রন্থে সামাজিক চুক্তি মতবাদের পূর্ণ ব্যাখ্যা দান করেন। তার মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল সহজ, সরল, উত্তম ও সহানুভূতিশীল। যেখানে কোন হিংসা, দ্বেষ ও প্রতিশােধ স্পৃহা ছিল না। প্রকৃতির রাজ্য ছিল এক আদর্শ রাজ্য। তিনি এ অবস্থাকে ‘পৃথিবীর স্বর্গ' বলে অভিহিত করেন। কিন্তু ক্রমশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পত্তির ধারণায় প্রকৃতির রাজ্যে বিশৃঙ্খলা, দেখা দিল। এ অবস্থার অবসানের জন্য মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। এ চুক্তির ফলে জনগণ তাদের সকল ক্ষমতা একটি সাধারণ ইচ্ছার উপর অর্পণ করে। রুশাের চুক্তিতে সাধারণ ইচ্ছা ছিল সার্বভৌম। রুশাের মতানুসারে, "voice of the people is the voice of God."

উপসংহারঃ উপযুক্ত আলােচনা শেষে বলা যায় যে, সামাজিক চুক্তি মতবাদটি একেবারে মূল্যহীন নয়। আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে সামাজিক চুক্তি মতবাদের উপর ভিত্তি করে। জন লক ও রুশাে উভয়ই বলেছেন, “মানুষ নিজেই তাদের রাজনৈতিক ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক।” তাদের জীবনের অধিকার ও সম্পত্তির অধিকার সংরক্ষণের জন্যই মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করেছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক