উপস্থাপনাঃ ‘সত্য মিথ্যার সংঘাত পৃথিবীর ইতিহাসের চিরন্তন অনিবার্য অধ্যায়।'- ইতিহাসের এ রূঢ় বাস্তবতার ফলেই মহানবী (স)-এর মিশন ক্ষণিকের স্তব্ধতা নিয়ে অপশক্তির মুখােমুখি হয়েছিল। এভাবে ক্রমান্বয়ে মিথ্যার প্রচণ্ড শক্তির দর্প চূর্ণ করে বিশ্ব বিজয়ের সােপান আবিষ্কৃত হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে এরূপ একটি ঘটনাই হলাে তাবুক যুদ্ধ।
নামকরণঃ এ যুদ্ধ সিরিয়া সীমান্তে অবস্থিত তাবুক নামক স্থানে সংঘটিত হয়েছে বলে একে তাবুকের যুদ্ধ বলা হয়। মুসলমানরা তাবুক গমনকালে পথিমধ্যে গ্রীষ্মের সূর্যের প্রচণ্ড কিরণ ও প্রখর তাপে এবং পানির ভয়ানক কষ্ট পায়। এ যুদ্ধে অশেষ কষ্ট ভোগ করতে হয় বলে এর নাম গাজওয়াতুল ওসরাৎ তথা কষ্টের যুদ্ধ রাখা হয়।
তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময় ও স্থানঃ তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তদানীন্তন বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রােমানদের বিরুদ্ধে। হিজরী নবম সাল মােতাবেক ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মদিনা থেকে ৪০০ মাইল দূরে সিরিয়া সীমান্তে অবস্থিত তাবুক নামক স্থানে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
তাবুক যুদ্ধের কারণঃ যেসব কারণে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেগুলাে নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
১. ইহুদিদের প্ররােচনাঃ আরব ভূখণ্ডে ইহুদিরা মুসলিম বাহিনীর সাথে বার বার পরাজিত হয়ে খায়বার অভিমুখী জনপথে নাশকতামূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। ইহুদিরা রােমান সম্রাটকে মুসলমানদের ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া শক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক এবং মদিনা আক্রমণের জন্য প্ররােচনা প্রদান করে।
২. মুতার যুদ্ধে খ্রিস্টানদের বিপর্যয়ঃ রােম সাম্রাজ্যের অধীন সিরিয়ার শাসক শােরাহবিল ইবনে আমরের লক্ষাধিক খ্রিস্টান সৈন্যকে মুতার যুদ্ধে মুসলমানগণ শােচনীয়ভাবে পরাজিত করলে রােমান সম্রাট ক্ষুব্ধ হয়। ফলে সে মুসলমানদের সমুচিত শিক্ষা প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
৩. মিথ্যা সংবাদের প্রভাবঃ খােদাদ্রোহী মুসলিম বিদ্বেষী শক্তি রােমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসকে মহানবী (স)-র মৃত্যুবরণ করার মিথ্যা সংবাদ প্রদান এবং এটাই নবােস্থিত মুসলিম শক্তিকে পর্যুদস্ত করার মােক্ষম সুযােগ বলে অভিহিত করে। রােমান সম্রাট এ মিথ্যা সংবাদে উৎসাহী হয়ে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
৪. ইসলামের শক্তি সম্পর্কে রােমান সম্রাটের সূক্ষ্ম দৃষ্টিঃ ইসলামের ভীতিহীন অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী অবস্থানে উন্নীত হওয়ার প্রতিটি ধাপ রােমান সমাট সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে। মুসলমানদের মক্কা বিজয়, হুনাইন ও তায়েফের বিজয় রােমানদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। তাই রােমানরা মদিনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামের রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
৫. মদিনা আক্রমণের অনুকূল পরিবেশঃ সমগ্র আরব উপদ্বীপে অজন্মা ও দুর্ভিক্ষের কারণে তথাকার অধিবাসীদের অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয় হয়ে পড়েছিল। আর মদিনায় ছিল তখন খেজুর আহরণের মৌসুম। গ্রীষ্মের খরতাপ ও পানির তীব্র সংকট জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। রােমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস এ বিপর্যকর পরিস্থিতিতে মুসলিম শক্তিকে ধ্বংস করে মদিনা দখলের সুবর্ণ সুযােগ মনে করে যুদ্ধাভ্যিানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
৬. রােমানদের অভিযানঃ ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে রােমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস মদিনা আক্রমণের বিষয়টি চূড়ান্ত করে। রোম সাম্রাজ্যের তালান লাখম, জুযাম, গাসসান, আমেলাই প্রভৃতি কয়েকটি আরব গােত্রও প্রায় এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে রােমান বাহিনীতে শামিল হয়।
মুসলমানদের প্রস্তুতি ও ঘটনাঃ রোমানদের দাভিযানের খবর পেয়ে তা প্রতিহত করা এবং সিরিয়া অভিমুখী বাণিজ্যিক পণ নিরাপদ রাখার জন্য মুসলিম মুজাহিদরা সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হন। মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীতে পদাতিক সৈন্য সংখ্যা ছিল ১০,০০০, অশ্বারােহী ৩০,০০০। মদিনা থেকে ৪০০ মাইল দূরে সিরিয়া সীমান্তে অবস্থিত তাবুক নামক স্থানে মুসলিম মুজাহিদ বাহিনী শপশের গতিরােধ করেন। এ যুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা) তার সমস্ত সম্পত্তি, ওমর (রা) অর্ধেক সম্পত্তি এবং ওসমান (রা) ১০০০। স্বর্ণমুদ্রা, এক হাজার উট ও ৭০টি অস্ত্র যুদ্ধ তহবিলে দান করেন। তথা মুসলমানদের বিরাট যুদ্ধ আয়ােজন ও শক্তি সাহস প্রত্যক্ষ করে রোমানরা মুসলমানদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়। অবশেষে রাসূল (স) সেখানে ২০ দিন অবস্থান করে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। তাবুকে যেহেতু কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি, তাই এটাকে তাবুক যুদ্ধ না বলে তাবুক অভিযান বলা হতো।
তাবুক যুদ্ধের ফলাফলঃ ইসলামের ইতিহাসে তাবুক যুদ্ধের ফলাফল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। নিম্নে এর ফলাফল আলােচনা করা হলাে-
১. ইসলামী রাজনীতির প্রসারঃ তাবুক যুদ্ধে তদানীন্তন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তি রােমান বাহিনীর পলায়নের ফলে উত্তর আরবের সীমান্ত অঞ্চলে রােমানদের অধীনস্থ ছােট ছােট রাজ্যসমূহের প্রধানগণ মদিনা রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করে জিযিয়া কর প্রদানে স্বীকৃত হয়।
২. ইসলামী রাষ্ট্রের সম্প্রসারণঃ তাবুক অভিযানের পর মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি পায়। তাবুক অভিযানের পর উত্তর আরব থেকে শুরু করে দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন পর্যন্ত সকল ইহুদি ও খ্রিস্টান রাজা মদিনা রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করে। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের বিপুল সম্প্রসারণ ঘটে।
৩. সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দুর্বলতা প্রকাশঃ তাবুক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সাম্রাজ্যবাদী রােমান বাহিনী ও তাদের সহযােগীদের পশ্চাদপসরণে তাদের সামরিক শক্তির দুর্বলতাই ফুটে ওঠে। ভবিষ্যতে মদিনা আক্রমণ করে তথাকার রাষ্ট্রশক্তিকে নির্মূল করার দুঃসাহস পােষণের মানসিক শক্তি তারা হারিয়ে ফেলে।
৪. ইসলামের প্রসারঃ তাবুক অভিযানের পর আরব উপদ্বীপ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইসলাম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন গােত্র যারা এতদিন ইসলাম গ্রহণ করেনি তারা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। রাসূল (স)-এর সাথে যারা এতদিন ঘাের শত্রুতায় লিপ্ত ছিল, আজ তারাই রাসূল (স)-এর পায়ে লুটিয়ে ধন্য হলাে। এভাবেই মদিনা কেন্দ্রিক ইসলাম বিশ্বের চারদিকে প্রসারিত হয়।
৫. মহানবী (স)-এর রাষ্ট্র পরিচালনায় মনােনিবেশ ও তাবুক যুদ্ধেঃ রােমান বাহিনী ও তার মিত্রদের পরাজয়ের ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার মতাে আর কোনাে শক্তি অবশিষ্ট থাকেনি। ফলে মহানবী (স) তার শাসন সংস্কারের সুযােগ পান। এতে তিনি ইসলামকে সর্বজনীন করার প্রয়াস চালান।
উপসংহারঃ ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে তাবুক অভিযান একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এ অভিযানে খােদাদ্রোহী সকল অপশক্তির বিনাশ ঘটে। এ অভিযানে রােমানদের পলায়নের সূত্র ধরেই ইসলামের প্রসার ঘটে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি পায়।
0 মন্তব্যসমূহ