উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর


প্রশ্নঃ উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, উত্তম সংবিধানে কী কী গুণ বিদ্যমান?
অথবা, উত্তম সংবিধানের বিশেষত্বসমূহ কী কী?
অথবা, উত্তম সংবিধানের প্রকৃতি উল্লেখ কর।

ভূমিকাঃ প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই একটি সংবিধান থাকে। সংবিধান ব্যতিত কোন রাষ্ট্রই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। সংবিধান হলাে রাষ্ট্রের তথা সমগ্র জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের একটি সুনির্দিষ্ট পন্থা। সংবিধানের মাধ্যমে জনসাধারণের আশা-ভরসার প্রতিফলন ঘটে। তাই একে হতে হবে উত্তম এবং আদর্শ স্থানীয়। উত্তম না হলে উক্ত সংবিধান না থাকার সমতুল্য। রুশের মতে, “একটি সুস্থ ও শক্তিশালী সংবিধান হলাে সবচেয়ে বড় চাওয়ার বিষয়" (A healthy and strong constitution is the first thing to be sought.)

উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যঃ নিম্নে উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা করা হলাে-

১. সুস্পষ্টতাঃ সুস্পষ্টতা উত্তম সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সংবিধানের ধারা স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ হওয়া আবশ্যক, যেন সে বিষয়ে সহজে সঠিক জ্ঞানলাভ করা যায়। কোন বিষয়ে যেন বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয় সেদিকের প্রতি নজর রাখা কর্তব্য। কোন জটিল বা দ্বি-অর্থের প্রয়ােগ থাকা বাঞ্ছনীয় নয়, কারণ এতে ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ থাকে। সহজে বােধগম্যতা উত্তম সংবিধানের একটি বৈশিষ্ট্য। এর ভাষা হবে সহজ ও সাবলীল।

২. সংক্ষিপ্ততাঃ "Constitution shall be good which is as short as possible." -K. C. Wheare. সংক্ষিপ্ততা উত্তম সংবিধানের অপর একটি বৈশিষ্ট্য। এটার বিভিন্ন ধারা, উপধারা সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় যাতে এটার মধ্যে অযথা অপ্রয়ােজনীয় প্রসঙ্গের অনুপ্রবেশ না ঘটে। তবে সংক্ষিপ্ত করার জন্য প্রয়ােজনীয় বিষয়াদিকে বাদ দেয়া যাবে না। সকল বিষয়ের উল্লেখ থাকা প্রয়ােজন। তাই সংক্ষিপ্ততা এবং ব্যাপকতা উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য।

৩. দায়িত্বঃ যে কোন দেশের উন্নতি ও প্রগতি নির্ভরশীল সেদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর। অতএব সংবিধান এমনভাবে তৈরি হবে যাতে রাজনৈতিক দলগুলাের পারস্পরিক বিরােধ না থাকে। এমতাবস্থায় সংবিধান অবশ্যই স্থায়ী হতে হবে। সাংবিধানিক কাঠামাের স্থায়িত্ব না থাকলে রাজনৈতিক দলগুলাে ইচ্ছামতাে এর অপব্যবহার করতে পারে। ফলে সংবিধানের স্থায়িত্ব হচ্ছে উত্তম সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য।

৪. ব্যাপকতাঃ ব্যাপকতা উত্তম সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গঠন, রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়ােগ পদ্ধতি, শাসক শাসিতের সম্পর্কের রূপরেখা প্রভৃতি সম্পর্কে বিধিবিধান সংবিধানে উল্লেখ থাকা উচিত। অধ্যাপক গেটেল (Gettell) এর মতে, "A constitution should be comprehensive, that is, it should cover the whole field of government." [Gettell, Political Science, P-247]

৫. লিখিত রূপঃ উত্তম সংবিধান লিখিত হওয়াই শ্রেয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সংবিধান লিখিত না হলে অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে অচলাবস্থা দেখা দিবে। অন্যান্য সরকার ব্যবস্থায়ও সংবিধান লিখিত এবং দুষ্পরিবর্তনীয় রাখা হয়। এতে সরকার যেমন এর কর্তৃত্বের সীমারেখা বুঝতে পারে তেমনি জনগণও তাদের অধিকারের মাত্রা সম্পর্কে জানতে পারে।

৬. মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণঃ আদর্শ সংবিধান শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির উল্লেখ থাকলেই হবে না। এর মধ্যে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত হওয়া আবশ্যক। ফলে সরকার ব্যক্তির কোন মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করলে সে আদালতের স্মরণাপন্ন হয়ে প্রতিকার চাইতে পারে। অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, “উত্তম সংবিধানে অবশ্যই মৌলিক অধিকারগুলাে সন্নিবেশিত হবে।”

৭. উত্তম সংশােধন পদ্ধতিঃ সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন যাতে রাজনৈতিক দলগুলাের খেয়ালের বিষয়ে পরিণত হয় সেটিকে নিশ্চিত করা উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য। উত্তম সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হবে না, আবার দুষ্পরিবর্তনীয়ও হবে না। এ দু'য়ের মধ্যবর্তী পন্থাই হবে এর কাম্য। এমতাবস্থায় এরূপ সংবিধান কেবল দেশের প্রয়ােজনীয় মুহূর্তেই সংশােধিত হবে। এ প্রসঙ্গে উইলােবী বলেছেন, "Rigidity and eligibility are the two opposing tendencies of a good constitution."

৮. সময়ােপযােগীঃ আদর্শ সংবিধান হবে সময়ােপযােগী। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মানসিকতা ও মূল্যবােধের পরিবর্তন হচ্ছে। সংবিধানকে এমন হতে হবে যেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে পারে। এরিস্টটলের মতে, “সেই সংবিধানই ভালাে যা পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে পারে।" (That constitution is best which is best attainable under circumstances.)

৯. ভারসাম্য রক্ষাঃ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের ভারসাম্য রক্ষাও উত্তম সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সরকারের সকল বিভাগের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান থাকা জরুরি। আবার জনগণের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

১০. জনমতের অগ্রাধিকারঃ উত্তম সংবিধানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কেননা এরূপ সংবিধান সকল দলমত নির্বিশেষে সবার প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত একটি গণপরিষদ বা কর্তৃত্বসম্পন্ন কোন সংস্থা কর্তৃক রচিত হয়। ফলে, এরূপ সংবিধান জনমতের ধারক ও বাহক হয়। জনমতের প্রতি লক্ষ্য রেখেই সময়ে সময়ে সংবিধান পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে যুগােপযােগী হবে।

১১. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থাঃ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। উত্তম সংবিধানই এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। অর্থাৎ সংবিধান এমনভাবে প্রণীত হবে যাতে বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের স্বৈরাচার থেকে ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করতে পারে এবং সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে। তাই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি উত্তম সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়।

১২. সামাজিক ঐতিহ্যপূর্ণঃ উত্তম সংবিধানকে অবশ্যই সামাজিক ঐতিহ্য এবং জাতীয় পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি হতে হবে। কেননা সংবিধানের মাধ্যমেই একটি দেশ, রাষ্ট্র ও জাতির পরিচয় লাভ করা যায়। সংবিধানের মাধ্যমেই জাতির স্বকীয়তা ও মৌলিকত্ব ফুটে উঠে।

১৩. আইনের অনুশাসনঃ উত্তম সংবিধানে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আইনের দৃষ্টিতে সাম্য ও আইনসমূহের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিতকরণ করা উত্তম সংবিধানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য।

১৪. গণতন্ত্রঃ উত্তম সংবিধানের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলাে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র না থাকলে উত্তম সংবিধান নিশ্চিত করা যায় না। K.C.Wheare বলেছেন, “উত্তম সংবিধানের জন্য গণতন্ত্রই হলাে উত্তম ক্ষেত্র।”

১৫. সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষাঃ উত্তম সংবিধানে সার্বভৌম ক্ষমতা সংগতিপূর্ণ উপায়ে বণ্টন করা হয়। অর্থাৎ উত্তম সংবিধানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা। আইনসভার সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব বণ্টন ক্ষেত্রে উত্তম সংবিধান বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সরকার ও জনগণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যাবশ্যক নতুবা গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের ভয় থেকে যায়।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, একটি দেশের সংবিধান উত্তম কি না তা উপযুক্ত বৈশিষ্ট্য থেকে জানা যায়। তবে সংবিধানের নীতি বা বৈশিষ্ট্যকে যতই নিরপেক্ষ ও উত্তম চরিত্র দান করা হােক না কেন তার সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে সরকার কিভাবে এটিকে পরিচালিত করবে তার উপর। উত্তম সংবিধান দ্বারা একটি জাতির চরিত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। উত্তম সংবিধান হলাে রাষ্ট্রের প্রাণস্বরূপ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক