অথবা, ডকুমেন্ট স্টাডির সংজ্ঞা দাও। ডকুমেন্ট-এর উৎস ও প্রকারভেদ আলোচনা কর। সমাজ গবেষণায় ডকুমেন্ট স্টাডির সুবিধা আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার, প্রশ্নপত্র ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহের কৌশল হিসেবে সমাজ গবেষণায় ব্যাপক প্রচলিত ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তবে সমাজ গবেষণার প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলি আরও একটি সূত্র হতে সুকৌশলে লাভ করা সম্ভবপর। উপরােক্ত পদ্ধতির ক্ষেত্রে গবেষণার ফলে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু ডকুমেন্ট স্টাডিতে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। তথ্যের উৎস হিসেবে প্রচলিত বা উপস্থিত তথ্যকে ডকুমেন্ট বিবেচনা করা হয়।
উৎসগত ভেদে ডকুমেন্টের প্রকারভেদঃ তথ্যের উৎসের ওপর ভিত্তি করে ডকুমেন্টকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ উৎসগত ভেদে ডকুমেন্ট-এর প্রকারভেদ - (১) প্রাথমিক ডকুমেন্ট, (২) মাধ্যমিক ডকুমেন্ট।
(১) প্রাথমিক ডকুমেন্টঃ একে প্রাথমিক তথ্যের উৎসও বলা হয়। যখন একটি ঘটনা বা অবস্থার সাথে প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুসভাবে জড়িত ব্যক্তির বর্ণনা বা বিবৃতি ধারণ করা হয় তখন তাকে প্রাথমিক ডকুমেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
উদাহরণঃ আত্মজীবনী, ডায়েরি ইত্যাদি। তবে বর্তমানকালে আধুনিক প্রযুক্তিগত উপায়ে সংরক্ষিত ডকুমেন্ট; যেমন নির্দিষ্ট কোনাে ঘটনা বা অবস্থার শাব্দিক ও প্রামাণ্য চিত্রের ক্যাসেট ইত্যাদিও প্রাথমিক তথ্য বা তথ্যের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
(২) মাধ্যমিক ডকুমেন্টঃ একে মাধ্যমিক তথ্যের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তথ্য সংগ্রহকারী নিজে যেখানে সংশ্লিষ্ট ঘটনার অংশগ্রহণকারি না হয়ে, বরং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারি বা চাক্ষুস পর্যবেক্ষণকারির কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করে অথবা ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যাদি পাঠ করে তথ্য সংরক্ষণ করেন তখন তাকে মাধ্যমিক তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
উদাহরণঃ আত্মচরিত যেমন একটি প্রাথমিক তথ্য বা তথ্যের উৎস হিসেবে চিহ্নিত তেমনি জীবনচরিত মাধ্যমিক তথ্য বা তথ্যের উৎস হিসেবে বিবেচিত।
ধরনগত দিক থেকে ডকুমেন্টের প্রকারভেদঃ উৎসের ভিত্তিতে ডকুমেন্টকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ডকুমেন্ট হিসেবে আলােচনা করা হয়েছে। কিন্তু সেভাবেই অথবা যার কাছ থেকেই ডকুমেন্ট সংগৃহীত ও সংরক্ষিত হােক না কেন বাস্তবে বিভিন্ন প্রকৃতির ডকুমেন্ট পরিলক্ষিত হয় যা সমাজ গবেষণাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। L.H Kidder এবং C.M Judd প্রকৃতি বা ধরনগত দিক থেকে ডকুমেন্টকে তিনভাগে বিভক্ত করে আলােচনা করেছেন। নিম্নে তা উপস্থাপন করা হলাে- (১) পরিসংখ্যান রেকর্ড (২) সংরক্ষিত জরিপলব্ধ তথ্য (৩) লিখিত রেকর্ড।
(১) পরিসংখ্যান রেকর্ডঃ সমাজে সংরক্ষিত অবস্থায় উপস্থিত বিভিন্ন পরিসংখ্যান তথ্য সমাজ-সদস্যদের লােকসংখ্যা, বয়স, লিঙ্গ, পারিবারিক আকৃতি, পেশা, বাসস্থান, ধর্ম, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদিসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে; এসবগুলােই পরিসংখ্যান রেকর্ড শ্রেণির ডকুমেন্ট হিসেবে পরিগণিত হবে।
(২) সংরক্ষিত জরিপলব্ধ তথ্যঃ বর্তমানকালে সমাজ গবেষণায় এমন কিছু কিছু সংরক্ষিত তথ্যের সহজ ও বহুল প্রয়ােগ করা হচ্ছে যেসব তথ্য সংগ্রহের একটি উদ্দেশ্য ছিলাে পরবর্তী গবেষণায় ব্যবহৃত হওয়া। জরিপলব্ধ ও কম্পিউটার ইত্যাদিতে সংরক্ষিত এসব তথ্যাবলি সমাজ-গবেষকগণ পরবর্তী গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে আসছেন। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (ICDDRB) তাদের নির্দিষ্ট এলাকার ওপর পরিচালিত জরিপ তথ্যাবলি সুশৃঙ্খলভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে সংরক্ষণ করেন।
(৩) লিখিত রেকর্ডঃ পরিসংখ্যান রেকর্ড এবং সংরক্ষিত জরিপ তথ্য ছাড়া অন্যান্য যেসব লিখিত উৎস হতে সমাজ গবেষক তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন সেগুলােকে এককভাবে লিখিত রেকর্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি ডকুমেন্ট, ব্যক্তিগত ডকুমেন্ট, যেমন- আত্মচরিত, ডায়েরি, চিঠিপত্র উল্লেখযােগ্য লিখিত রেকর্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বর্ণনামূলক তথ্যের সমষ্টি।
জরিপলব্ধ তথ্য অনুসারে ডকুমেন্ট এর প্রকারভেদঃ পরিসংখ্যান রেকর্ড সংরক্ষিত জরিপলব্ধ তথ্য- (ক) সরকারি ও বেসরকারি ডকুমেন্ট, (খ) ব্যক্তিগত ডকুমেন্ট, (গ) গণযােগাযােগ মাধ্যম।
(ক) সরকারি ও বেসরকারি ডকুমেন্টঃ সমাজ, ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন নথি ও তথ্যাদির সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং তা গবেষকের ব্যবহার করার তৎপরতা সাম্প্রতিককালের। এর আগে গবেষকদের এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পর্যায়ের ধারণকৃত তথ্যাবলির ওপর নির্ভর করে কাজ করতে হতাে। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের প্রথম ভাষণ যা থেকে তাদের পরবর্তী প্রশাসনিক মনােভাব সম্পর্কে অনুসন্ধান করা যায়।
(খ) ব্যক্তিগত ডকুমেন্টঃ মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায়ে এমন কিছু লিখিত তথ্যাবলি সংরক্ষণ করে, যা পরবর্তীকালে গবেষকদের তথ্যের উৎস বা তথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমনঃ আত্মচরিত, ব্যক্তিগত চিঠি, রােজনামচা ইত্যাদি।
(গ) গণযােগাযােগ মাধ্যমঃ পরিসংখ্যান রেকর্ড সংরক্ষিত জরিপলব্ধ তথ্য এবং আত্মচরিত ছাড়াও যেকোনাে সভ্যসমাজে সাধারণ জনগণকে অবহিত ও পরিচিত করার জন্যে বিভিন্ন মাধ্যমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এসব মাধ্যম হলাে সাধারণত সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, জার্নাল এবং অধুনা ব্যবহৃত চলচ্চিত্র, রিডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি।
ডকুমেন্ট স্টাডির সুবিধাঃ প্রত্যেক গবেষণা পদ্ধতির মতাে ডকুমেন্ট স্টাডিরও কিছু সুবিধা রয়েছে। যেগুলাে | নিম্নে উল্লেখ করা হলাে-
(১) অসাম্য ও দুষ্প্রাপ্য বিষয়াদি, যেসব অবস্থা বা বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান কাজে গবেষকের শারীরিক কোনাে প্রবেশাধিকার সম্ভব নয় সেসব বিষয়ের ওপর অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ডকুমেন্ট স্টাডি একমাত্র উপযােগী তথ্য সংগ্রহ মাধ্যম।
(২) ডকুমেন্ট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয় অর্থাৎ গবেষক ডকুমেন্ট ইত্যাদির সাথে একমুখীভাবে জড়িত থাকেন, তাই এখানে কোনাে প্রতিক্রিয়ার প্রভাব উপস্থিত হয় না।
(৩) দীর্ঘ সময়ব্যাপী কোনাে অনুসন্ধান কাজের জন্য এ পদ্ধতি বেশিমাত্রায় ফলদায়ক।
(৪) এ পদ্ধতিতে বিস্তৃত এলাকায় এবং বিরাট নমুনা নিয়ে জরিপের মতাে কাজ করা সম্ভব।
(৫) প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মতাে এখানেও স্বতস্ফূর্ততা, প্রাথমিক তৎপরতা বা অনুভূতি ধারণ করা যায়। যেমনঃ আত্মচরিত, রােজনামচা, চিঠিপত্র ইত্যাদি ব্যক্তির স্বতস্ফূর্ত অনুভূতির অভিব্যক্তি।
(৬) প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে ব্যক্তির অনেক সঠিক তথ্যই পাওয়া সম্ভব হয় না।
পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, প্রত্যেক গবেষণা পদ্ধতিতেই কিছু সুবিধা ও অসুবিধা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কেননা কোনাে গবেষণা পদ্ধতিই সমালােচনার উর্ধ্বে নয়। তবে ডকুমেন্ট স্টাডি যেসমস্ত অবস্থা বা বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান কাজে গবেষকের শারীরিক কোনাে প্রবেশাধিকার সম্ভব নয় সেসমস্ত বিষয়ের ওপর অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির কোনাে বিকল্প নেই। মূলত এই সকল ক্ষেত্রে ডকুমেন্ট স্টাডিই একমাত্র কার্যকরী ব্যবস্থা হিসেবে সমাজ গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে।
0 মন্তব্যসমূহ