অথবা, বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য নির্ণয় কর।
ভূমিকাঃ আধুনিক দর্শন জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন। যথার্থভাবে দর্শন আলােচনা করতে হলে জ্ঞানবিদ্যার আলােচনা প্রয়ােজন। জ্ঞানবিদ্যার আলােচনাই দর্শন আলােচনার মূল। কাজেই জ্ঞানবিদ্যাকে দর্শনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে দেখা হয়। জ্ঞানের উৎপত্তি কিভাবে হয়- এ প্রশ্নকে কেন্দ্র করে দর্শনের ইতিহাসে আমরা বিভিন্ন মতবাদ লক্ষ্য করি। সুতরাং জ্ঞানােৎপত্তি বিষয়ক যেসব মতবাদ রয়েছে, তার মধ্যে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
বুদ্ধিবাদঃ এ মতবাদ অনুসারে নিশ্চিত জ্ঞানের একমাত্র উৎস হল বুদ্ধি। অর্থাৎ চিন্তা ও বিচারবুদ্ধিই যথার্থ জ্ঞানের উৎস। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা সত্যিকারের জ্ঞান নয়। তা অসম্পূর্ণ ও অসঙ্গতিপূর্ণ। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে যে জ্ঞান পাওয়া যায় তা বস্তুর বাহ্য রূপের জ্ঞান, বস্তুর অন্তর্নিহিত স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞান নয়। ইন্দ্রিয় আমাদের সর্বজনীন জ্ঞান দিতে পারে না। আমরা একমাত্র বুদ্ধির সাহায্যে অর্থাৎ যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত বা সর্বজনীন জ্ঞান লাভ করতে পারি। কাজেই বুদ্ধিই যথার্থ জ্ঞানলাভের প্রধান উপায়। ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা পরিবর্তনশীল ও অনিশ্চিত।
বুদ্ধিবাদের ঐতিহাসিক আলােচনায় আমরা প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক- এ তিন যুগের সন্ধান পাই। প্রাচীন বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মধ্যে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল অন্যতম। মধ্যযুগে বুদ্ধিবাদ সম্পর্কে তেমন আলােচনা হয়নি। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে বুদ্ধিবাদী দার্শনিক হিসেবে ডেকার্ট, লাইবনিজ, ভলফের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
অভিজ্ঞতাবাদঃ অভিজ্ঞতাবাদ একটি অন্যতম জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ। এ মতবাদ অনুসারে অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। আধুনিক যুগের দার্শনিক বেকন, জন লক, বার্কলি ও হিউম ছিলেন অভিজ্ঞতাবাদের প্রধান সমর্থক। এই মতবাদের প্রথম বীজ বপন করেন বেকন। তবে লক হচ্ছেন আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদের জনক।
বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সমন্বয়ঃ কান্টের বিচারবাদ হচ্ছে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের ত্রুটি বিচ্যুতি দূরীকরণ ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে একটি যুগান্তকারী প্রয়াস। কান্ট প্রমাণ করেন যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দুয়েরই অবদান রয়েছে। তার মতে, অন্যান্য বস্তুর মত জ্ঞানেরও উপাদান ও আকার- এ দুটি দিক রয়েছে। কোন জ্ঞানই শুধু উপাদান বা শুধু আকার দিয়ে গঠিত হতে পারে না। যথার্থ জ্ঞানের জন্য উভয়ই প্রয়ােজন। অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের উপাদান পাই, আর আকার পাই বুদ্ধির কাছ থেকে। অভিজ্ঞতা জ্ঞানের আকার দিতে পারে না, অপরদিকে বুদ্ধি উপাদান দিতে পারে না।
কান্ট জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা উভয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। সে হিসেবে তিনি বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন। কান্টের মতে, জ্ঞানের দুটি দিক রয়েছে- আকার ও উপাদান। জ্ঞানের উপাদান আসে সংবেদন বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আর জ্ঞানের আকার আসে বুদ্ধিজাত ধারণা থেকে। জ্ঞানের জন্য এ দুয়েরই প্রয়ােজন। এভাবে কান্ট বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের অন্তর্নিহিত সত্য উদঘাটন করে উভয়ের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়,কান্ট জ্ঞানােৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়কে স্বীকৃতি দিয়ে জ্ঞান সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এসব দিক বিশ্লেষণ করলে কান্টের বিচারবাদ যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করেছে তা দর্শনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ