‘প্রাচীন চীনে ধর্ম বলতে কিছু ছিল না, যা ছিল তা ধর্মীয় দর্শন’– আলােচনা কর


প্রশ্নঃ ‘প্রাচীন চীনে ধর্ম বলতে কিছু ছিল না, যা ছিল তা ধর্মীয় দর্শন’– আলােচনা কর।
অথবা, প্রাচীন চীনের ধর্ম ও দর্শন আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে চীনের সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে বিস্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পুরাতন মূল্যবােধ বর্জন করে নতুন মূল্যবােধের আলােকে চৈনিক দার্শনিক নতুন করে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। এ সময়ের চীনের ধর্ম দর্শন দ্বারা বিভিন্ন সভ্যতা প্রভাবিত হয়। আবার অনেকে বলেন যে, চীনের ধর্ম বলতে কিছু ছিল না, যা ছিল তা হলাে ধর্মীয় দর্শন। নিম্নে তা আলােচনা করা হলাে-

(১) চীনের ধর্মঃ সভ্যতার প্রথমদিকে চীনের ধর্ম প্রকৃতি পূজাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতাে। কিন্তু পরে এ ধর্ম দর্শনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে একেশ্বরবাদের মনােভাব সূচনা করে। এ সব ধর্মে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সাধারণ জনগণের কোনাে স্থান ছিল না। চীনের সাধারণ জনগণের মধ্যে পূর্ব-প্রচলিত রীতি-নীতির প্রচলন ছিল।

(ক) শাং যুগের ধর্মঃ শাংদের ধর্মবিশ্বাস প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও পরবর্তীকালে চীনে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে চীনাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। শাং আমলে চীনারা প্রাকৃতিক উপস্বর্গকে দেবতা মনে করে উপাসনা করত। তারা মাটি, নদী, বাতাস, ও দিকসমূহকে দেবতা ভাবত এবং তাদের উদ্দেশ্যে মন্দিরের ভেতরে পশু বলিদান করতাে। শাংরা অন্যান্য দিক দিয়ে সভ্য হলেও তাদের সময় নরবলী প্রথা প্রচলিত ছিল। যুদ্ধবন্দী ও দাসকে মৃত রাজার অনুচর হিসেবে সরবরাহের জন্য হত্যা করা হতাে।

(খ) চৌ আমলের ধর্মঃ চৌ আমলে চীনের ধর্মীয় অবস্থা শাংদের মতােই ছিল। তারা অসংখ্য দেবতার উপাসনা করতাে। নরবলীর প্রথা ক্রমেই সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্ত পশু বলি, কষিদ্রব্য ও পানীয় দেবতাদের নামে উৎসর্গ করা হতাে। পীত নদীর উত্তরে প্রায় ৩০ বর্গফটের একটা কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে ৭২টি ঘােড়া সমেত ১২টি সকট ও গলায় ঘন্টাযুক্ত ৮টি কুকুরের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। চীনারা প্রার্থনা লিখে তা অন্যান্য উপসর্গকৃত জিনিসের সাথে পুড়ে ফেলত।

(২) চীনের দর্শনঃ চৈনিক ধর্মের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য চীনের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সমসাময়িককালে চীনে আমরা ৫জন শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের পরিচয় পাই তারা হলেন- লাওৎসে, মাে-সে, কনফুসিয়াস, মেনসিয়াস এবং চুটসে। নিম্নে এ সব দার্শনিকদের দর্শন সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলােচিত হলাে-

(১) লাওৎসেঃ লাওৎসে ছিলেন তাওবাদের প্রতিষ্ঠাতা। তাওবাদ বস্তুজগৎকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে বলে বাস্তব কার্যকলাপের কোনাে সুযােগ এ ধর্মে ছিল না। তাওবাদ ছিল একটা উদ্যমহীন দর্শন। শেষ পর্যন্ত তাওবাদ অবশ্য চীনের বৌদ্ধ ধর্মের সাথে মিশে যায়। চীনে চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় প্রাথমিককালেই ধারণা জন্মে যে, ঈশ্বর মানুষের কৃতকর্মের বিচারক। এ থেকে চীনের চিন্তাবিদগণ ঈশ্বরের শাস্তি থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করেন।

(২) কনফুসিয়াসঃ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর পরে চৈনিক ধর্মের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ পরিবর্তনের মহানায়ক ছিলেন কনফুসিয়াস। তার ধর্ম দর্শন চৈনিক ধর্মকে প্রভাবিত করে। তার দর্শনের মূল লক্ষ্য ছিল মানব কল্যাণ ও চারিত্রিক শুদ্ধতা আনয়ন করা। কনফুসিয়াসের মতে, পরিবার হলাে রাষ্ট্র ও সমাজের মূল ভিত্তি। পরিবারের প্রধান হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পুরুষ।

(৩) মেনসিয়াসঃ কনফুসিয়াসের পরবর্তী দার্শনিক ছিলেন মেনসিয়াস। তার পূর্ব নাম ছিল মেং কি তেও। পরবর্তীতে তিনি মেনসিয়াস নামে পরিচিত হন। তিনি মূলত নৈতিকতা ও রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলােচনা করেছেন। মেনসিয়াস কনফুসিয়াসের একজন শিষ্য ছিলেন।

(৪) চুটসেঃ চীনের অন্যতম দার্শনিক ছিলেন চুটসে। তিনি কনফুসিয়াসের অনুসারী ছিলেন প্রথম জীবনে। কিন্তু পরবর্তীতে নিজ দৃষ্টিভঙ্গির আলােকে অনেক নতুন তথ্য সংযােজন করেছেন। এককথায় বলা যায়, কনফুসিয়াসের বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করে নিজস্ব কিছু কথা সংযােজনের মাধ্যমে তিনি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তার বক্তব্য ছিল রাজনীতি সম্পর্কে। তিনি বলেন, সরকার হলাে কিছু নৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের একটা সংস্থা। তিনি নৈতিকতার ওপর বেশি জোর দেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, চীনের ধর্ম অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তববাদী। তবে তাদের ধর্মে দ্বান্দিকতাও লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, চীনের ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে একটা নিরিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এরা একে অপরের পরিপূরক। মানব কল্যাণমুখী প্রবণতা চৈনিক ধর্ম ও দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক