পুরােপলীয় যুগ বলতে কী বুঝ?


প্রশ্নঃ পুরােপলীয় যুগ কাকে বলে?
অথবা, পুরােপলীয় যুগ বলতে কী বুঝ?
অথবা, পুরােপলীয় যুগের সংজ্ঞা দাও।
অথবা, প্রাচীন প্রস্তর যুগ কাকে বলে?
অথবা, প্রাচীন প্রস্তর যুগ সম্পর্কে আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ আধুনিক সভ্য জগৎ একদিনে বা এক বছরে সৃষ্টি হয়নি। যুগে যুগে নানা পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আধুনিক সভ্য জগতের অভ্যুদয় ঘটেছে। গবেষকগণ বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে বিভিন্ন যুগের নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকগণের খননকাজ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রাগৈতিহাসিক কালকে প্রাচীন প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, লৌহ যুগ ইত্যাদি কতিপয় সুনির্দিষ্ট যুগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাগৈতিহাসিক যুগের সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে মানুষ সে সময় যেসব পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন তার এবং মানবসমাজের বিকাশে পাথরযুগের বিশেষ গুরুত্বের কথা বর্ণনা করেছেন।

পুরােপলীয় যুগঃ পুরােপলীয় যুগ বা Paleolithic Age কে সরল শব্দে বলা যায় প্রাচীন পাথরের যুগ। এটি ছিল প্রস্তর যুগের প্রাথমিক পর্যায়। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রথম ভাগকে পুরোপলীয় বা প্রাচীন প্রস্তর যুগ বলা হয়। 

মানুষ পাথরের তৈরি হাতিয়ারের উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করতো বলে এ সময়কালকে প্রাচীন প্রস্তর যুগ বা পুরোপলীয় যুগ বলা হয়। 

গ্রিক শব্দ ‘Plaious’ অর্থ প্রাচীন এবং ‘Lithas’ অর্থ পাথর। এই শব্দ দুটির সমন্বয়ে ইংরেজি Palaeolithic শব্দের উদ্ভব হয়েছে। সুতরাং প্রাচীন পাথর নির্ভর সমাজেকেই প্রাচীন প্রস্তর যুগ বা পুরোপলীয় যুগ বলা হয়।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ পুরােপলীয় যুগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক জন জিউস বলেন, “The first and oldest of the primitive cultures which devised and used stone implements is called the old stone age” অর্থাৎ প্রাচীন প্রস্তর যুগ বা পুরোপলীয় যুগ বলতে ইতিহাসের সেই সময়কালকেই বুঝায় যেখানে সমাজ ও সংস্কৃতি পাথর নির্মিত হাতিয়ারের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।

পুরােপলীয় যুগের সময়কালঃ পুরােপলীয় যুগ ছিল প্রস্তর যুগের দীর্ঘস্থায়ী কাল। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্য মতে, প্রায় ২৬ লক্ষ বছর পূর্বে এ যুগের সূত্রপাত ঘটে এবং প্রায় ১০ হাজার বছর আগে এ যুগের অবসান ঘটে। 

অন্যদিকে "সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি" বইয়ের লেখক "ডঃ মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান" এর ভাষ্য মতে, প্রায় ৬ লক্ষ বছর পূর্বে এ যুগের সূত্রপাত ঘটে এবং খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ বছর কাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

পুরােপলীয় যুগের প্রকারভেদঃ ঐতিহাসিকগণ পুরোপলীয় বা প্রাচীন প্রস্তর যুগকে ৩টি ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা-

১. প্রাথমিক প্রাচীন প্রস্তর যুগ
২. মাধ্যমিক প্রাচীন প্রস্তর যুগ
৩. শেষ প্রাচীন প্রস্তর যুগ

১. প্রাথমিক প্রাচীন প্রস্তর যুগঃ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্য মতে, প্রায় ২৬ লক্ষ বছর পূর্বে এ যুগের সূচনা ঘটে এবং প্রায় ১০ লক্ষ বছর পূর্বে এ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ যুগের মানুষেরা ছিল অরণ্যচারী ও গুহাবাসী। এরা বনে বনে ঘুরে খাদ্য সংগ্রহ করত। কালক্রমে এরা পাথর ঘষে সুচালো আর তীক্ষ্ণ অস্ত্র তৈরি করে পশু শিকারের কৌশল আবিষ্কার করতে শুরু করে। 

অন্যদিকে "সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি" বইয়ের লেখক "ডঃ মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান" এর ভাষ্য মতে,
নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগ হচ্ছে ৬,০০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ বছর আগে। এ সময়ে মানুষ পাথরের হস্ত-কুঠার ব্যবহার করতো। তবে সেগুলো ছিল মোটা ও ভোতা৷ পাথরের গায়ে সে যুগে নদীর গতিপথ খোদাই করা থাকতো। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানব প্রতিনিধি হচ্ছে জার্মানীতে প্রাপ্ত হেইডেলবার্গ মানব, ইন্দোনেশিয়ার জাভা মানব এবং চীনের পিকিং মানব। 

২. মাধ্যমিক প্রাচীন প্রস্তর যুগঃ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্য মতে, আনুমানিক ১০ লক্ষ বছর পূর্বে এ যুগের সূচনা ঘটে এবং প্রায় ২ লক্ষ বছর পূর্বে এ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ যুগের মানুষ আগুনের ব্যবহার জানতো। তারা শরীরের আবরণ হিসেবে পশুর চামড়া ব্যবহার করতো। এ সময়ে মানুষ পাথরের তৈরি ঘরবাড়ি তৈরি করা শুরু করে। শিকারের জন্যে পাথরের তৈরি অস্ত্র ও পশুর হাড় দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরি এ সময়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

অন্যদিকে "সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি" বইয়ের লেখক "ডঃ মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান" এর ভাষ্য মতে,
মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ ১,০০,০০০ বছর আগে শুরু হয় (এবং ৩০,০০০ বছর পূর্বে শেষ হয়)। এ সময়ের পাথর নির্মিত হাতিয়ার পূর্ববর্তীকালের তুলনা অধিকতর সরু ও ধারালো ছিল বলে প্রমাণ মেলে। মৃতের কবর দেওয়ার প্রচলনও ছিল বলে জানা যায়। জার্মানীতে প্রাপ্ত নিয়ানডারথাল মানব ছিল এ সময়ের বাসিন্দা। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই নিয়ানডারথালেরা বাস করতো। নিয়ানডারথাল মানবরা শিকারী জীবনে অভ্যস্ত ছিল।

৩. শেষ প্রাচীন প্রস্তর যুগঃ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্য মতে, আনুমানিক ২ লক্ষ বছর পূর্বে এ যুগের সূচনা ঘটে এবং প্রায় ১০ হাজার বছর পূর্বে এ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ সময়ে পৃথিবীর ভূভাগ ক্রমশ গরম ও আদ্র হয়ে উঠে। ফলে মানুষ পশু ও মৎস শিকারে অধিক আগ্রহী হয়ে পড়ে। কালক্রমে মানুষ এ সময়ে নতুন নতুন আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে সভ্যতাকে গতিশীল করে তুলেছিল। হাঁড় নির্মিত হারপুন ও সুঁচ আবিষ্কারের ফলে পশু শিকার করা অনেকটাই সহজ হয়ে পড়েছিল এ যুগে। 

অন্যদিকে "সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি" বইয়ের লেখক "ডঃ মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান" এর ভাষ্য মতে,
উচ্চ (শেষ) প্রাচীন প্রস্তর যুগের যাত্রা শুরু হয় ৩০,০০০ বছর পূর্বে এবং তা খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ বছর কাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ সময়ের বাসিন্দা হচ্ছে ক্রোম্যাগনন মানব। ক্রোম্যাগনন মানব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিকারী সমাজে সংগঠিত ছিল। তারা তীর-ধনুকের ব্যবহার আয়ত্ত করে। তারা পাথর নির্মিত হাতিয়ারের মানকে আরো উন্নত করতে সক্ষম হয়। গুহাবাসী এই ক্রোম্যাগননেরা গুহার দেয়ালে ছবি অংকন করতো। এদের মধ্যে বয়স ও লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাগও দেখা দেয় বলে জানা যায়। 

পরিশেষঃ মানবসভ্যতার ইতিহাস সম্ভবত প্রস্তর যুগেই শুরু হয় এবং তা পুরােপলীয় প্রস্তর যুগে। প্রয়ােজনের তাগিদে মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে টিকে থাকার জন্য লড়াই করেছে। প্রস্তর যুগেই মানুষ শিকার, মাছ ধরা, ফলমুল সংগ্রহ ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনধারণ করেছে। পাথরের অস্ত্রের মাধ্যমে হিংস্র জানােয়ারের কবল থেকে রক্ষা পাবার প্রয়াস পেয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পেয়েছে মানুষ এ যুগেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক