‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের দাদাসাহেবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ কর


প্রশ্নঃ ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের দাদাসাহেবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) ‘চাঁদের অমাবস্যা' (১৯৬৪) উপন্যাসের তৃতীয় যে চরিত্রটির কথা উল্লেখ করতে হয় তা দাদা সাহেবের। পাঁচ বছর আগে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে গ্রামে বাস করছেন। পূর্বে গ্রামের সাথে তার সংযােগ থাকলেও তা ছিল অনিয়মিত, তিনি কেবল ছুটি-ছাটাতেই দেশে আসতেন। জীবনভর চাকরি করলেও কর্মক্ষেত্রে কোনাে পদোন্নতি তার হয়নি। কেননা মাজহাব-শরিয়ত ব্যাপারে সর্বদা তিনি মশগুল থাকতেন। তাই মনিবের বিধর্মিতায় কষ্টবােধ করা ছাড়া নিজের চাকরি জীবন সম্পর্কে তার কোনাে ক্ষোভ নেই- বরং চাকরিজীবনের শেষে তিনি এই ভেবে পরিতৃপ্ত ও প্রশান্ত যে, এখন তিনি নিজের সময়ের মােল আনা মালিক হলেন।

‘চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসটির মতে দাদাসাহেবের স্বাভাবিক স্থৈর্য-গাম্ভীর্য সহজে তারতম্য ঘটে না। কিন্তু ধর্মের বিষয়ে তিনি স্বাভাবিকতা রক্ষা করতে পারেন না। চাকরি থেকে অবসরের পরে দাদাসাহেব বাড়িতে এসে বুঝতে পারলেন যে, তার অবসর সময়ােচিত হয়েছে। বাড়িতে সংখ্যায় দশাধিক বালক-বালিকা। তার গ্রামবাসী বড়ছেলের ছয়টি ছেলেমেয়ে- বিধবা মেয়েও পাঁচটি সন্তান। তাদের শিক্ষাদীক্ষার একান্ত প্রয়ােজন। তাদের সে বাসটি শিক্ষা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিল; অনেকটা সার দেওয়া জমির মতাে। ধর্মের ব্যাপারে দাদাসাহেব মাঝে মাঝে অসংযত হয়ে পড়েন। তাকে দেখে ধর্মের বিষয় মনে করে অনেক বয়ােবৃদ্ধব্যক্তিরা শ্রদ্ধা-সমীহ করে। কেননা, ধর্মের ব্যাপারে তিনিই শিশুর মতাে সরল বা প্রাণবন্ত বালকের মতাে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারেন। দাদাসাহেবের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তার বিধবা কন্যা আনােয়ারা ও তার পুত্র ফজলু অন্যতম। অবসরপ্রাপ্ত দাদাসাহেব যত্নবান হলেন পারিবারিক ধর্ম ও নীতিনৈতিকতা শিক্ষায়। তার বাড়ি ফেরার এক মাসের মধ্যেই পরিবারের সর্বত্রই প্রবাহিত হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষার বাতাস এবং ক্রমান্বয়ে তা আরাে ঘনীভূত হয়ে তার গার্হস্থ্য পরিবেশকে করেছে আমূল প্রভাবিত। ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন-
“প্রথম সপ্তাহে তিনি নির্দেশ দিলেন, বিসমিল্লাহ না বলে কেউ যেন লােকমা না তােলে। শীঘ্র আর এক হুকুম হলাে, কালো একটি নামাজ যেন কাজা না হয়। তারপর ঈমানের অর্থ, কুরআন পাঠ ও হাদিস-সুন্নাহর প্রয়ােজনীয়তা, তসবি পড়ার উপকারিতা, নফল নামাজের কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ ব্যাখ্যান দিতে লাগলেন।”

কাদেরের জন্মকালে দাদাসাহেবের ওয়ালেদ বয়ােবৃদ্ধ। শেষ-বয়সের সন্তান কাদেরের প্রতি তাই তার পিতার মাত্রারিক্ত স্নেহ ও প্রশ্রয় ছিল। বিদ্যালয়ে গেলেও স্কুলের শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতির প্রতি অনিষ্ঠ ও বীশ্রদ্ধ কাদের কেবলই পরিজনদের কাছে ‘বিদ্রোহী ছেলে’ বলে পরিচিত হয়েছে, বিদ্যালাভ করতে পারেনি। কাদেরের আঠারাে-উনিশ বছর বয়সে দাদাসাহেব তার কর্মস্থলে নিয়ে গিয়ে কাদেরকে ধর্মের ব্যাপারে শিক্ষা দানের চেষ্টা করেন। অতঃপর কাদেরের কিছু ‘আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়েছে’ বলে তিনি মনে করেছেন। কিন্তু বাস্তবে দাদাসাহেব কাদেরের চারিত্রিক কোনাে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছেন।

ইতিহাস সম্পর্কে দাদাসাহেব তার নিজস্ব মতামতে চলেন। তিনি মনে করেন ইতিহাস মানুষের সৃষ্টি; তার মতে মানুষের সৃষ্টির কথা তুললে ভালাে-খারাপের কথা ওঠে। দয়াবান নিষ্ঠাবান খলিফা উমর বা রশীদ-মামুনের কথা তুললে ইয়াজিদ-হাজ্জাজ বিন ইউসুফের-মুতাওয়াজিলের নৃশংসহীনতা বিশ্বাসঘাতকতা ঢেকে রাখা যায় না। কখনাে কখনাে দাদাসাহেব ভাবেন দ্বিতীয় দলই বুঝি সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের কথা ভাবলে দাদাসাহেবের হৃদকম্পন বেড়ে যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায় নির্দয় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ একাই পনেরাে হাজার মানুষের মস্তক ছেদন করে এবং ওবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদ ‘কসাই' নামে খ্যাত হয়েছিল। দাদাসাহেব বুঝেন পাপ-মন্দের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম চিরন্তন। খােদা মানুষকে সত্যপথ দেখান কিন্তু কতজন সে পথে যেতে পারে- থাকতে পারে? মানুষের মনের পঙ্কিলতা, চারিত্রিক দোষঘাট হিংস্রতা অমানুষিকতা কোনাে বিষয় সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দিহান হতে পারেন না। দাদাসাহেব তার মনের জিজ্ঞাস্য অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান না। তাই তিনি কদাচিৎ ইতিহাসের প্রসঙ্গ নিয়ে কম কথা বলেন।

দাদাসাহেবের ধর্মবোধ তার নিজস্ব আদর্শ-লালিত। তিনি পরম সত্যে বিশ্বাসী কিন্তু পারিবারিক আভিজাত্য বােধ। বেশ গর্বিত ও অন্তলোকে স্ফীত। ওয়াজ নসিহত করলেও দাদাসাহেব কখনাে কাউকে তিরস্কার করেন না। দাদাসাহেব প্রতিষ্ঠিত স্কুলের পরিবেশ এবং শিক্ষকদের আচরণও চাঁদের অমাবস্যার বহির্বাস্তবতাকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বড়বাড়ির অভিভাবক ও আরেফের আশ্রয়দাতা দাদাসাহেব আলফাজউদ্দীন বাঙালি মুসলমান সমাজের উদ্ভট ঐতিহ্যবােধ ও আভিজাত্যগর্বী মনােভাবের প্রতিনিধি-অতীতের স্মৃতিচারণের মধ্যেই তার অপররিসীম আনন্দ। ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন-
“তাদের ঘােড়াশালে তখন ঘােড়া ছিল, হাতিশালে হাতি। খিল্লাত পরিধান করে রেশমের খরিতায় পত্রাদি বাধতেন; খাসমহল, আতর-বাইদমস্কের সুগন্ধিতে ভরপুর করতাে এবং উৎসবের দিনে বাদশাহি কায়দায় পথে-ঘাটে মােহর ছড়াতেন। তখন আবদার-চোবদার রাখতেন গণ্ডায় গণ্ডায়; সবর-সেবন্দিও পুষতেন। আজ সেদিন আর নাই।”

এ মানসিকতা যেন মুসলমানদের অকারণেই ইরাক, ইরান, আরব তুরস্ক, খােরাশান, বাগদাদ, দামেস্ক, গ্রানাদার হারানাে ঐশ্বর্য ও শৌর্য-বীর্যের কাছে পলায়নী আত্মসমর্পণ। এ মানসিকতার কারণেই দেখা যায়, সুদূর মার্কিন মুলুকে এক নিগ্রোর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সংবাদ পাওয়ার পর দাদাসাহেব আলফাজউদ্দীন গ্রামবাসীদের জেয়াফেত খাওয়ান। দাদাসাহেব ধর্মান্ধ। চাকরি জীবনে বিধর্মী মনিবের প্রতি বিতৃষ্ণার রেশ ধরে গ্রামের বাড়িতে অবসর জীবনযাপন করতে এসে তিনি কঠোর হাতে তার পরিবারে ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরােপ করেন এবং গড়ে তােলেন একটি ধর্মীয় পরিমণ্ডল। বাড়ির ছােটো ছােটো ছেলে মেয়েদের ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাদানে তিনি সদাসতর্ক। কাদেরের মধ্যে একটা দরবেশি ভাব আছে সে কথা তিনি প্রচার করেন।

সেই দাদাসাহেব তারই আশ্রিত গৃহ-শিক্ষক অরেফ আলীর কাছে পিতৃপুরুষের মর্যাদায় সমাসীন ছিলেন। কিন্তু এই মানুষটিই তার সমস্ত ন্যায়নিষ্ঠা আভিজাত্যময় জীবনের বিপরীতে চলে গেলেন ছােটোভাই কাদেরের অপকর্মের সংবাদ শােনার পর। দাদাসাহেব তখন পারিবারিক মান-মর্যাদা, ছােটোভাই এর সম্মান প্রতিপত্তির রক্ষক হয়েও ওঠেন। আরেফ লক্ষ করে হঠাৎ লম্বা-চওড়া সম্ভান্ত মানুষটি যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন। বুঝা যায়, বাইরে চাকচিক্যময় ধর্মীয় লেবাস সত্ত্বেও উচ্চবিত্তের শ্রেণি-স্বার্থ শেষ পর্যন্ত একে সত্য ও ন্যায়ের বিপরীত বলয়ে নিয়ে যায়, তার কার্যকলাপ পর্যবসিত হয় ভণ্ডামি ও কপটতায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক