নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা কর


প্রশ্নঃ নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নীতিবিদ্যা কাকে বলে? নীতিবিদ্যা পাঠের উপযােগিতা আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ নীতিবিদ্যা মানুষের আচরণের কোনাে বিশেষ ধরনের আলােচনা না করে সামগ্রিক আলােচনা করে বলে নীতিবিদ্যা বিচার্য বিশেষ উদ্দেশ্য বিবেচনা না করে পরম উদ্দেশ্যকেই বিচার করে থাকে। পরম উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে সমগ্র জীবন আবর্তিত হয়। এই পরম উদ্দেশ্যকেই নীতিবিদ্যায় পরম কল্যাণ বলা হয়। পরম কল্যাণ মানুষের নৈতিক আদর্শ। এই পরম কল্যাণের আলােকে মানুষের আচরণের আলােচনা নীতিবিদ্যায় করা হয়ে থাকে। মানব জীবনের মূল্যবান অনুসন্ধান হিসেবে মানব ক্রিয়া ও মানব মঙ্গলের অনুশাসনে যেসব নিয়ম জড়িত, সেগুলাের আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে মানুষের নৈতিক ব্যবহারের পদ্ধতিগত অনুসন্ধান হলাে নীতিবিদ্যা। নিম্নে নীতিবিদ্যার সংজ্ঞা এবং নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়ােজনীয়তা আলােকপাত করা হলাে।

নীতিবিদ্যার সংজ্ঞাঃ
নীতিবিদ্যার উৎপত্তিগত অর্থঃ নীতিবিদ্যার ইংরেজি 'Ethics', যা গ্রিক শব্দ 'Ethica' থেকে আগত। আবার 'Ethica' আগত 'Ethos' থেকে। Ethos অর্থ আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি ও অভ্যাস। ইংরেজিতে যাকে 'Moral philosophy' বলে। 'Moral' শব্দটি ল্যাটিন শব্দ 'Mores' থেকে আগত। যার অর্থ আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি ও অভ্যাসের আলােচনা। সুতরাং শব্দের দিক থেকে নীতিবিদ্যাকে মানুষের রীতিনীতি বা আচার-ব্যবহার সম্পর্কীয় আলােচনা বলা যেতে পারে।

নীতিবিদ্যার প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ সাধারণত নীতিবিদ্যার মানুষের আচরণ বলতে ঐচ্ছিক ও অভ্যাসগত ক্রিয়াবােধকে বুঝায়। কেননা, ইচ্ছাকৃত ও অভ্যাসজাত ক্রিয়াবলির মাধ্যমে মানুষের চরিত্রের বিকাশ ঘটে। অনিচ্ছাকৃত, সহজাত বা স্বতঃস্ফুর্ত ক্রিয়ায় মানুষের বিচার-বিবেচনা ও নির্বাচন শক্তি কাজ করে না।

William Lillie points out that Ethics is the normative science of conduct of human beings in societies. (An Introduction to Ethics-1964, P-1,2)

W.K Fanrkena points out that Ethics is the normative philosophy or philosophical thinking about morality moral problems and moral judgments.

P.W. Tylor points out that Ethics may be defined as a philosophical inquiry into the nature and 'ground of morality.

Aristotle বলেন “যে বিদ্যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের ভালাে-মন্দ বিচার করে তাকে নীতিবিদ্যা বলে।”

ম্যাকেঞ্জি বলেন, “আচরণের ন্যায় বা ভালাে নিয়ে যে আলােচনা করা হয় তাকে নীতিবিদা বলে।”

অলিভার এ. জনসন বলেছেন, “মানব জীবনের মূল্যায়ন অনুসন্ধান হিসেবে মানব ক্রিয়া ও মানব মঙ্গলের অনুশাসনে যেসব নিয়ম জড়িত সেসব আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে মানুষের নৈতিক ব্যবহার সুসংহত অনুসন্ধান-ই নীতিবিদ্যা।”

নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়ােজনীয়তাঃ নীতিবিদ্যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের পরম কল্যাণের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে। কেননা, নীতিবিদ্যা তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে আলােচনা করে। নীতিবিদ্যার কেবল একটা আত্মধর্মী আগ্রহ আছে এবং এর ব্যবহারিক কোনাে প্রয়ােগ নাই। প্রতিটি জ্ঞানের শাখার পাঠের প্রয়ােজনীয়তা আছে। তাই মানব জীবনে নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। নিম্নে নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়ােজনীয়তা আলােকপাত করা হলােঃ

১. ধ্বংসাত্মকমূলক দিকঃ সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে যদি কোনাে ত্রুটি থাকে তবে বিজ্ঞান তার সংশােধনের চেষ্টা করে। নীতি বিজ্ঞান ভালাে, মন্দ, সৎ, অসৎ, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতির বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রকৃত অর্থ নির্ধারণ করে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলাের মধ্যে যেসব ত্রুটি আছে নীতিবিদ্যা সেগুলাের সমালােচনা করে দোষ ক্রটি উদঘাটন করে। এ হলাে নীতিবিদ্যা পাঠের ধ্বংসাত্মক মূলক দিক।

২. সংগঠনমূলক দিকঃ নীতিবিদ্যা মানুষের আচরণের ভালােত্ব এবং মন্দত্ব সম্পকে জ্ঞান দিয়ে সহায়তা করে। সৎ জীবন যাপনের জন্যে যে নৈতিক দৃষ্টির প্রয়ােজন, নীতিবিদ্যা পাঠ করে তা আমরা লাভ করতে পারি। যে নীতিবিদ্যা পাঠ করেছে সে সাধারণ যেকোনাে ব্যক্তির তুলনায় কিভাবে বিশেষ ক্ষেত্রে নীতি বিজ্ঞানের নিয়মগুলােকে প্রয়ােগ করতে হয় সে বিষয়ে অধিকতর অন্তদৃষ্টি দেখাতে সক্ষম হবে। এটা নীতিবিদ্যার সংগঠনমূলক দিক।

৩. কর্তব্যবােধ সৃষ্টিঃ নীতিবিদ্যা নৈতিকভাবে মানুষকে কর্তব্যবােধে উৎসাহিত করে। নীতিবিদ্যা পাঠের ফলে মানুষের অধিকার কর্তব্য, দায়িত্ব কি সে সম্পর্কে জানতে পারে। তাই গভীর জ্ঞানের নীতিবিদ কখনাে ভুল করতে পারে । তাছাড়া যে ব্যক্তি নীতিবিদ্যা পাঠ করেছে সে সাধারণ ব্যক্তির চেয়ে নীতিবিদ্যার বিষয়কে সফলভাবে প্রয়ােগ করতে পারে।

৪. নৈতিক চেতনা সৃষ্টিঃ নীতিবিদ্যা পাঠের মাধ্যমে আমাদের মাঝে নৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়। শুধু তাই নয় জীবন যাপনের জন্য সব কিছু সম্পকে জানা যায়। সৎ, সুন্দর, আদর্শ ও নৈতিক জীবন যাপনের জন্য নীতিবিদ্যা পাঠ আবশ্যক। নীতিবিদ্যা আমাদের আচরণকে উন্নত করে এবং নৈতিক চেতনাকে তীব্রতর করে তােলে। ফলে আমরা সমাজ, দেশ ও বিশ্বে শান্তিতে থাকতে পারি।

৫. মানব গুণাবলি শেখায়ঃ নীতিবিদ্যা একটি আদর্শ বিদ্যা বিজ্ঞান। নীতিবিদ্যা মানুষকে নানা গুণাবলি শিক্ষা দেয়। মানুষের আচরণ উন্নত করাই নীতিবিদ্যার কাজ। ফলে মানুষ আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে উঠতে পারে। তাই বলা যায় যে, আদর্শের দ্বারা মানুষের চরিত্রের মূল্য নির্ণয় করা হয়। সে আদর্শের স্বরূপ নির্ণয় করাই নীতিবিদ্যার লক্ষ্য।

৬. তাত্ত্বিক জ্ঞানের আলােচনাঃ নীতিবিদ্যা কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞানের জন্য ভালাে-মন্দের প্রেক্ষিতে মনের আচরণের আলােচনা করে। তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের কাজ হলাে তত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান দান করা। ম্যাকেঞ্জি বলেন, ‘নীতিবিদ্যা হলাে মানব জীবনের সাথে জড়িত আদর্শ সম্পর্কীয় সাধারণ বিদ্যা।”

৭. উন্নত জীবন গঠনঃ নীতিবিদ্যা পাঠে আমরা উন্নত জীবন গঠন সম্পর্কে জানতে পারি। নৈতিক মূল্যবােধের অবক্ষয়কে রােধ করতে হলে নৈতিকতা শিক্ষার প্রয়ােজন আছে। এ জন্য নৈতিকতার তাত্ত্বিক জ্ঞানের দরকার। কেননা, তাত্ত্বিক জ্ঞানের যুক্তিসম্মত ধারণা কোনাে না কোনােভাবে মানুষের মনে প্রভাব পড়ে। তাই নীতিবিদ্যা মানুষের সুস্থ জীবন গঠন করতে বিরাট ভূমিকা পালন করে।

৮. পরম আদর্শ সৃষ্টিঃ নীতিবিদ্যা মানুষের মনে পরম কল্যাণ, পরম আদর্শ, পরম চেতনা জাগায়। সামাজিক রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক আচার-ব্যবহারের ত্রুটি দেখিয়ে দোষ মুক্ত করার চেষ্টা করে। মূলত নীতিবিদ্যা একটা নৈতিক আদর্শ সৃষ্টি করে। আর যদি তা না করত তবে প্রতিষ্ঠান উৎপীড়কের উৎস ও অনিষ্টের উদ্ভাবক হয়ে দাঁড়াত।

৯, বাস্তব জীবনে প্রভাবঃ নীতিবিদ্যা আমাদের বাস্তব জীবনে বেশ কার্যকর। ধর্ম, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি এবং সমাজ ও শিক্ষার উপর নীতিবিদ্যার প্রভাব বেশি। ভালাে-মন্দের মাধ্যমেই আমরা ধর্ম, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি এবং সমাজ ও শিক্ষা, ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে থাকি। নীতিবােধ না থাকলে আমরা ভালাে মন্দ বুঝতাম না। তাই নীতিবিদ্যার প্রভাব বাস্তব জীবনে অস্বীকার করা যাবে না।

১০. Wiliam Lilie-এর বাণীঃ “বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে পথ নিদের্শ করাই নীতিবিদ্যার প্রধান উপযােগিতা নয়। সাধারণভাবে নৈতিক ব্যাপার সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার এবং আমাদের উদ্দেশ্যকে দৃঢ় করাই এর প্রধান কাজ। নীতিবিদ্যার পাঠকরা সাধারণ মানুষ অপেক্ষা অনেক বেশি জানে এবং তা জানার ও যথেষ্ট কারণ আছে। সে জন্য নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়ােজনীয়তা আছে।”

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নীতিবিদ্যা আমাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তীক্ষ করে, কর্তব্যবােধ সৃষ্টি করে, নৈতিক চেতনা জাগায়, মানবিক গুণাবলি শেখায়, তাত্ত্বিক জ্ঞানের আলােচনা করে, উন্নত জীবন গঠনে সহায়ক, পরম আদর্শ সৃষ্টি করে এবং সর্বপরি বাস্তব জীবনে তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি তাে আছেই। উক্ত গুণাবলি কোনাে দেশের নাগরিকদের মাঝে থাকলে সে দেশ অনেক উন্নত হবে। আর যদি সঠিক প্রয়ােগ না ঘটে তবে সে দেশ অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বেশি দূরে যেতে পারবে না। তাই সুস্থ সমাজ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে নীতিবিদ্যার প্রয়ােজনীয়তা ও মূল্যকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক