‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাস অবলম্বনে বাসন্তী চরিত্র বিশ্লেষণ কর


প্রশ্নঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাস অবলম্বনে বাসন্তী চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
অথবা, ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কে? তার চরিত্রের বিস্তারিত বর্ণনা দাও।

উত্তরঃ অদ্বৈত মল্লবর্মণের [১৯১৪-১৯৫১] ‘তিতাস একটি নদীর নাম' [১৯৫৬] উপন্যাসের প্রধান বা কেন্দ্রীয় চরিত্র বাসন্তী। একমাত্র বাসন্তীই এ উপন্যাসের প্রতিটি অংশে উপস্থিত থেকেছে। অন্যরা কিশাের-সুবল-অনন্তর মা ‘জন্ম মৃত্যু বিবাহ' অংশে মৃত্যুবরণ করে। অনন্তকে নয়া বসতের আগে পাওয়া যায় না। উদয়তারা রমু খুশী বনমালী রামধনু অংশ থেকে ক্রমে হাজির হয়। সমস্ত উপন্যাসে বাসন্তীর উপস্থিতি সব সময়ই লক্ষ করা যায়। বাসন্তীর মধ্য দিয়েই ঔপন্যাসিক মালােদের জীবনধারাটি ব্যাপকভাবে উপস্থাপনের সুযােগ পেয়েছে। অনেক সময় মনে হয়, তিনি বাসন্তীর মাধ্যমে মালােদের জীবনধারার এক ধরনের প্রতীকী উপস্থাপনায় উৎসাহিত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসের একটি অংশ উদ্ধৃত ধরা যায়-
“সুবলার বউ নিজেও আর উঠিতে পারে না। পা টিপ টিপ করে। মাথা ঘােরে। চোখের সামনে দুনিয়ার রঙ আরেক রকম হইয়া যায়। সে ভাবিয়া রাখিয়াছে, সকলের যা গতি হইয়াছে আমারও তাই হইবে। তার জন্য ভাবিয়া কোন লাভ নাই। কিন্তু ঘরে জল থাকা দরকার। শেষ সময়ে কাছে জল না থাকিলে নাকি ভয়ানক কষ্ট হয়।”
উপন্যাসের অন্তিম পর্যায়ে, মালােদের জীবন বিপর্যয়ের শেষ প্রান্তে এসে এ বক্তব্য থেকে তিতাসে জল শূন্যতাজাত ভয়াবহ পরিণতির ইশারা মেলে। তিতাস ও বাসন্তীর ধারাবাহিক উপস্থিতিতে উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠে একটি পরিণতিতে পৌছেছে। বাল্যকালে বাসন্তীর মাঘমণ্ডপের ব্রত তৈরিতে অংশ নিয়েছিল কিশাের ও সুবল। জলে ভাসানাে চৌয়ারি ধরার জন্য দুই ডানপিটে ছেলের দ্বন্দ্ব বেঁধে যায়। তাদের এ ঝগড়া বিবাদ বাসন্তীকে কষ্ট দিয়েছে। বিশেষকরে বাসন্তী ব্যথিত হয়েছে কিশােরের জন্য। এ প্রসঙ্গে বাসন্তী বলেছে-
“মা, ওমা দেখ, সুবল দাদা কিশাের দাদার কাণ্ড! আমি চৌয়ারির জলে ছাড়তে না ছাড়তে তারা দুই জনে ধরতে গিয়া কি কাইজ্যা। এ কয় আমি নিমু, হে কয় আমি নিমু। ডরে আর কেউ কাছেও গেল না। শেষে কি মারামারি।”
বাসন্তী তাদের এই কাড়াকাড়ি সইতে না পেরে দুজনকেই রাখতে বলেছে চৌয়ারি। কিশাের বাসন্তীর কথা মেনে নিয়ে ছেড়ে দেয় চৌয়ারি পাবার আশা। বাসন্তী মনের কোণে সূক্ষ্ম দরদ লুকিয়ে ছিল কিশােরের জন্য। প্রবাস খণ্ডে শুকদেবপুরের খলা বাইতে যাওয়ার সময় কিশাের ও সুবলের মধ্যে প্রেমভাব লক্ষ করা যায়। উভয়ে এ বিষয়ে আলাপ করেছে। সুবল ভেবেছে, বাসন্তী কিশােরের হাঁড়িতে চাউল রেখেছে।

কিন্তু কিশােরের মন রােমান্টিকতার পাখায় ভর করে উড়ে চলেছে অপ্রাণীয়ের খোঁজে। ফলে কিশােরের সঙ্গে বিয়ে হলােনা বাসন্তীর। শুকদেবপুরের কিশােরের বিয়ে হলাে অনন্তর মায়ের সঙ্গে, যাকে নিয়ে ফেরার পথে ডাকাত দলের কবলে পড়ে স্ত্রী ও অর্থ সবই হারালাে সে। ফলে সে হারিয়ে ফেললাে মানসিক ভারসাম্য। অন্যদিকে বাসন্তীর বিয়ে হলাে সুবলের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের পর পরই সুবলের মৃত্যু ঘটে জিয়ল মাছের কাজ করতে গিয়ে। বাসন্তীর পরিচয় কালক্রমে দাঁড়ালাে সুবলার বউ। সুবল আকৃষ্ট বাসন্তীর প্রতি, বাসন্তীর প্রেম কিশােরের জন্য, কিশাের পাগল হলাে অনন্তর মায়ের জন্য, অনন্তর মা অনুসন্ধানে রত পাগল হওয়া কিশােরের জন্য, এ এক জটিল পরিস্থিতি। সে কারণেই হয়তাে বাসন্তী মুগ্ধ অনন্ত ও তার মায়ের প্রতি। বাসন্তী যেন কিশাের সুবল অনন্ত অনন্তর মা সকলের সঙ্গেই নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত; কিন্তু বাস্তবে সে কাছে পায় না কাউকেই। তবু বাসন্তী তার মানসিক সবলতা ও পরিশ্রমী স্বভাব নিয়ে সুতাে কেটে জীবিকা নির্বাহ করেছে। এবং একই সঙ্গে সে সমাজের ভাগ্য পরিবর্তনের দায়িত্ব অনেকখানি কাঁধে তুলে নিয়েছে। সে কারণেই হয়তাে মালাে সমাজে নারীরা কখনাে কখনাে হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট। কালােবরণের মা, উদয়তারা, অনন্তর মা এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্ম বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র মহিমায় মাললা পাড়ায় উজ্জ্বল।

কিশােরের প্রতি বাসন্তীর ভালােবাসার প্রকাশ ঘটেনি; প্রেমের শেষ আভাটুকু মিলিয়ে যায় কিশােরের উদগ্রস্ততায় এবং তা তার মনের গভীরে জ্বালিয়ে রাখে অন্তহীন বেদনার দীপশিখা। অন্যদিকে সুবলের সঙ্গে বিয়েতেও সুখি হয়নি বাসন্তী। একজনকে ভালােবেসে অন্য জনকে বিয়ে করার বিড়ম্বনা বেশি দিন অবশ্য সইতে হয়নি বাসন্তীকে। সুবল মারা গেছে জিয়ল মাছ ধরতে গিয়ে। সে মরণ ছিল বড় বিভৎস, ঝড়ের সময় নৌকার সঙ্গে তীরের আঘাত ঠেকাতে নদীতে নামলে সুবল একা নৌকার গতি থামাতে পারেনি। ফলে তাকে পড়তে হয় নৌকার নিচে। স্বামীর মৃত্যু আর পূর্ব প্রেমিকের উন্মাদ হওয়ার ঘটনার মাঝখানে পড়ে যেন অনেকটা নিস্তব্ধ হয়ে যায় বাসন্তী।

বাসন্তী বন্ধুবৎসল। সে কারণেই সে মঙ্গলার বউয়ের চেয়েও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে অনন্তর মাকে সমাজভুক্ত করার ক্ষেত্রে। এবং অনন্তর মাকে সাহায্য করতে গিয়েই তার দ্বন্দ্ব হয় নিজ মায়ের সঙ্গে। অভাবই যেন তার নৈতিকতা টিকিয়ে রাখতে দেয়নি। অন্য পাড়ায় ময়নার সঙ্গে কথা বলা নিয়েও তার মায়ের সঙ্গে বাসন্তীর হয়েছে বিবাদ। এ প্রসঙ্গে বাসন্তী তার মাকে বলেছে-
“মনে কইরা দেখাে কোন শিশুকালে বিয়া দিছিলা মইরা গেছে। জানলাম না কিছু, বুঝলাম না কিছু। সেই অবুঝ কালে ধর্মে কাচারাড়ি বানাইয়া থুইছে। সেই অবধি পােড়া কপাল লইয়া বনে বনে মাইগগা ফিরি। তােমরা ত সুখে আছ। তােমরা কি বুঝবা আমার দুঃখের গাঙ কত গহীন। আমার বুঝি সাধ আহ্লাদ নাই।”
এ যেন বঞ্চিত এক নারীর জীবন বেদনার প্রকাশ। বাসন্তী এই জীবনাগ্রহ, জীবন তৃষ্ণা থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে যে সমাজ, সেখানে বিধবা বিয়ের প্রচলন ঘটাতে পারিনি রামপ্রসাদ। তার নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী হলাে এক পর্যায়ে অনন্তর মা। সে কারণেই অনেক ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে অনন্তর মাকে সাহায্য করেছে বাসন্তী। তবে বাসন্তীর এ সাহায্যের অন্তরালে মানবিক মূল্যবােধ এবং কিশােরের প্রতি তার ভালােবাসার প্রভাবও রয়েছে বলে মনে করা যায়। এ প্রসঙ্গে একজন সমালােচক বলেছেনঃ “তা না হলে অনন্তকে ঘিরে এই সর্বরিক্ত নারীর বেঁচে উঠার আকাঙ্ক্ষা পুষ্ট হবার কোন অর্থ নেই।”

বাসন্তীকে ঔপন্যাসিক ‘বিপ্লবী নারী' বলে উল্লেখ করেছেন। তার মন, বিপ্লবী হতে প্রলুব্ধ হয়েছে বিদ্যমান সমাজকাঠামাে বদলাতে। ফলে বাসন্তী হয়নি অনন্তর মায়ের মতাে সংসারী। বাসন্তী জেগে উঠতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে অর্থনৈতিক শােষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বাসন্তী হয়ে ওঠে গােকনঘাটের জনমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রতিনিধি। বাসন্তী সুবলের জীবন দেখেই বুঝেছে, ধনীরা দরিদ্র মজুর শ্রমিকদের প্রতি অনুকূল নয়। সে জন্যই হয়ত বাসন্তী বাইরের সংস্কৃতিতে হয়েছে অবিশ্বাসী; বাজাইরা সংস্কৃতি, চটুল যাত্রার প্রতি জন্মেছে তার ক্ষোভ। পাটনীপাড়ার অশ্বিনীর গান প্রথম দিন সহ্য হলেও দ্বিতীয় দিন তার অসহ্য মনে হয়েছে। বাসন্তী তাই বেরিয়েছে রণমূর্তি নিয়ে এবং সবার সামনে বলেছে-
“ইটা আমার বাপের দেশ ভাইয়ের দেশ, ইখানে আমি কারুকে ডরাইয়া কথা কই না। ইখানে আমারে যেজন আজনাইব, এমন মানুষ মার গর্ভে রইছে।”
বাসন্তীর এই বিদ্রোহী মনই এক দিন মালাে পাড়ার মেয়েদের প্রতি কুদৃষ্টি দেওয়া তেলিপাড়ার এক যুবককে দিয়েছে জীবনের শিক্ষা। তারই অনুপ্রেরণায় মালােদের জোয়ান ছেলেরা তাকে মালােপাড়া ও ভদ্র লােকদের পাড়ার মধ্যে তৈরি হয় বিরাট দ্বন্দ্ব। মালােপাগল সংস্কৃতি ভাঙার ষড়যন্ত্র করতে চেয়েছে, কিছু সংখ্যক মাললা তার সঙ্গে একত্র হয়ে নিজ মালাে গােষ্ঠীর মর্যাদা রক্ষায় ঝাপিয়ে পড়েছে। এক পর্যায়ে বাসন্তী ফিরে এসেছে আপন গৃহে মায়ের কাছে। সে যেন তার মাকে অধিকার করেছে নতুন করে। কিশাের, সুবল, অনন্তর মা, সন্তানতুল্য অনন্ত কেউই তার আপন হলাে না। অন্য দিকে সে ফেরাতে পারে না নিজ সংস্কৃতির ভাঙনও। যখন নদী শুকিয়ে মালােদের অস্তিত্ব বিপন্ন করলাে, তখনও বাসন্তী খুঁজেছে স্নেহ বাৎসল্যের আশ্রয়। সে অনুধাবন করেছে নির্ভরতার আশ্রয় ছাড়া বাঁচা যায় না। এই অনুভবের কারণেই বাসন্তী আগ্রহী হয়েছিল অনন্ত-অনন্তবালার বিয়েতে অনন্তর মায়ের ভূমিকা গ্রহণ করতে। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে বাসন্তী কিছুটা ব্যর্থ হলেও, তিতাস নদী মরে গেলেও, সে দিনের সেই তিতাস ও তার তীরবর্তী মানুষের জীবন প্রবাহে বাসন্তীই হয়ে থাকলাে সবচেয়ে স্মরণযােগ্য চরিত্র।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক