কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন কর


প্রশ্নঃ বাংলাদেশ কী একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র? আলােচনা কর।
অথবা, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাে কী কী? বাংলাদেশ কী একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র?
অথবা, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন কর।

ভূমিকাঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রগুলােতে জনসাধারণের ভালাে-মন্দ ও সুখ-শান্তির সামগ্রিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হয়। এই কারণে আধুনিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুবিধ দায়িত্ব সম্পাদন করতে হয়। অতীতে রাষ্ট্রের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল শাসকশ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করা। শান্তি ও শৃঙ্খলা বিধান করাই তখন রাষ্ট্রের অন্যতম কার্য বলে মনে করা হয়। অপরাধমূলক অন্যায় কার্য রাষ্ট্রের মৌলিক কার্য হিসেবে বিবেচিত হতাে।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যঃ কার্যাবলী ও কল্যাণ রাষ্ট্রের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও কার্যাবলী রয়েছে। নিম্নে তার বর্ণনা দেওয়া হলাে-

(১) ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিধানঃ রাষ্ট্রের সংবিধানে সন্নিবেশিত নাগরিক অধিকারগুলাে প্রত্যেক নাগরিককে ভােগের নিশ্চয়তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করে। এ ছাড়া সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যাবলি ও আগ্রাসনবাদীদের কবল থেকে জনগণকে মুক্ত রাখা কল্যাণ রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও কাজ।

(২) উৎপাদন ও বন্টন নিয়ন্ত্রণঃ উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকে বণ্টন ব্যবস্থার ওপরও প্রয়ােজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরােপ করতে হয়। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সাফল্যের পথে ধনবৈষম্য একটি বড় বাধা। তাই রাষ্ট্র বন্টন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে ধনবৈষম্য হ্রাসের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হয়।

(৩) অর্থনৈতিক পরিকল্পনাঃ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে দেশের উন্নতির জন্যে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এ পরিকল্পনাতেই সমাজের রূপরেখা কী হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা থাকে।

(৪) প্রতিরক্ষা বিধানঃ দেশকে বৈদেশিক আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে, যাতে রাষ্ট্রের কোনােরূপ ক্ষতিসাধিত না হয়। এ ছাড়া বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে দেশকে এবং দেশের জনগণকে রক্ষা করার জন্য কল্যাণ রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দেওয়ানী, ফৌজদারী, অন্যান্য আইন ও বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি করতে হয়।

(৫) ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণঃ জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে মানুষের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে পালন করতে হয়।

(৬) ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তাঃ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার বিকাশসাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী করে। শুধু তাই নয়, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র জনগণের সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও সচেষ্ট হয়।

(৭) জনগণের কল্যাণসাধনঃ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য বা কাজ হচ্ছে জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধন। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলের স্বার্থরক্ষার জন্য কাজ করে থাকে। রাষ্ট্রের সকলপ্রকার কাজের মানদ, হলাে জনকল্যাণ। সে জন্যে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে থাকে।

বাংলাদেশ কী একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রঃ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন বিদেশী শাসন ও শােষণের অধীনে নিষ্পেষিত হওয়ার পর স্বাধীন এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হবার লক্ষ্য নিয়েই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে স্বীকতি লাভ করে। তারপর একের পর এক স্বীয় শাসন হলেও সত্যিকারে কল্যাণ বাংলাদেশে আসেনি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সার্বিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে একটি কল্যাণমূলক দেশ বলা যায় না। যেমন- কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকার বেকার ভাতা প্রদান করে, অর্থনীতিকে পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু বাংলাদেশে তা লক্ষণীয় নয়। তবুও সরকার কিছু কিছু জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি নিয়েছে, তা বিবেচনায় আবার কল্যাণমূলকও বলা চলে। নিম্নে সরকার কর্তৃক গৃহীত জনকল্যাণমূলক কাজের বর্ণনা প্রদত্ত হলাে-

(১) জনসেবামূলক কার্য সম্পাদনঃ রাস্তাঘাট ও রেলপথ নির্মাণ, হাসপাতাল, মাতৃসদন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা, বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থাসহ আরাে অনেক সেবামূলক কাজ বাংলাদেশ সরকার জনগণের কল্যাণের জন্য করে থাকে।

(২) সর্বজনীন কল্যাণসাধনঃ সর্বজনীন কল্যাণসাধনের জন্য বাংলাদেশ সরকার জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা করে আসছে।

(৩) সামাজিক নিরাপত্তাঃ শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও নারীদের আপদকালীন সময়ের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য পারিবারিক ভাতা, দলীয় বীমা ও কল্যাণ তহবিলের ব্যবস্থা আছে।

(৪) ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা দানঃ জনগণের সুপ্ত গুণাবলী বিকাশের জন্য বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা বিস্তার, সংস্কৃতির প্রসার ও অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।

(৫) ছাত্রীবৃত্তি ও বেতন মওকুফঃ সরকার অস্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীবেতন মওকুফ করেছে ও মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের জন্য পর্যায়ক্রমে বৃত্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেছে।

(৬) নাগরিক অধিকার সংরক্ষণঃ কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশ সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত মৌলিক অধিকারসমূহ উপভােগের সুযােগ জনগণকে দিয়েছে ও সেগুলাে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।

(৭) অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণঃ ধনী-গরীবের মধ্যে আয়ের ব্যবধান কমিয়ে সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাকল্পে সরকার নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

(৮) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ বাংলাদেশ সরকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গােত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রতি সমান দৃষ্টি রেখে শােষণ, জুলুম ও অন্যায় অত্যাচারের হাত থেকে সকলকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে।

(৯) অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নঃ বাংলাদেশ সরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, বিধানে খুবই তৎপর। এজন্য বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

(১০) ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাঃ সরকার প্রান্তিক ও মধ্যম চাষীদের জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করেছে। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ মওকুফ করেছে।

(১১) প্রাকৃতিক দুর্যােগের সময় সাহায্যঃ সরকার প্রাকৃতিক দুয়ােগের সময় দুঃস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তাদের সাহায্য সামগ্রী দিয়ে মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করে।

(১২) অধিকার ও কর্তব্য সংরক্ষণঃ একটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র তার মধ্যে বসবাসরত নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্যের যথাযথ সংরক্ষণ করে। একইভাবে বাংলাদেশও তার জনগণের অধিকার ও কর্তব্যের যথাযথ বাস্তবায়নের সর্বাত্মক চেষ্টা করে।

(১৩) পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবাঃ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রদান করে, তেমনটি আমাদের চিকিৎসা সেবা তুলনামূলক কম হলেও একেবারে কম নয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। বাংলাদেশ মূলত অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে প্রকৃত কল্যাণসাধনের লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশে হাজারাে সমস্যা ও অসামর্থ্যের কারণে সে লক্ষ্য পরােপুরি বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তাই অনেক ক্ষেত্রে সরকারের কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভবপর হয়নি। আর যতটুকু হয়েছে তা প্রয়ােজনের তুলনায় খুবই নগণ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক