পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা আলােচনা কর


প্রশ্নঃ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা আলােচনা কর।
অথবা, পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা বর্ণনা কর।
অথবা, পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা তুলে ধর।

ভূমিকাঃ সমাজবিজ্ঞান একটি সামাজিক বিজ্ঞান। তাই আধুনিক সমাজবিজ্ঞান সমাজ গবেষণায় বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ জন্য অন্যান্য বিজ্ঞানের ন্যায় সমাজবিজ্ঞানেরও কতকগুলাে বৈজ্ঞানিক স্বতঃসিদ্ধ পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে সমাজকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে একটি সামাজীকীকরণ করা যায়। সাধারণভাবে বলতে গেলে পদ্ধতি হচ্ছে কোনাে কিছু বিশ্লেষণের মান নির্ণায়ক। পদ্ধতিগুলাে মূল্যহীন নয়, পদ্ধতি সুনিশ্চিত। নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে বলেই প্রত্যেকটি বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত সুসংহত। তবে অনেকেই পদ্ধতি ও কৌশলকে এক করে ফেলে। পদ্ধতি এবং কৌশল এক নয়, কেননা তাদের মধ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।

পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সুবিধাঃ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহের কৌশলগুলাের তুলনায় পর্যবেক্ষণের বেশ কিছু প্রায়ােগিক সুবিধা রয়েছে। এ জন্য এ পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্মলগ্ন থেকে আজ অব্দি সমাদৃত হয়ে আসছে। পর্যবেক্ষণের উল্লেখযােগ্য সুবিধাগুলাে হলাে নিম্নরূপ-

প্রথমত, মানুষের ভাষাগত আচরণ ছাড়া অন্যান্য সকল আচরণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সঙ্গতকারণেই পর্যবেক্ষণ অন্যান্য কৌশল যেমন- সাক্ষাতৎকার, মাধ্যমিক তথ্যের ব্যবহার, প্রশ্নপত্র ইত্যাদির চেয়ে অধিকতর সুবিধাজনক।

দ্বিতীয়ত, এ পদ্ধতিতে মানুষের আচরণ সঠিক ও বাস্তবিকভাবে ধারণ করা সম্ভব হয়ে থাকে। উপযুক্ত পর্যবেক্ষণীয় ঘটনা বা আচরণ সাধারণত প্রাকৃতিক পরিবেশেই প্রকাশ পায় বলে পর্যবেক্ষক ঘটনার কৃত্রিমতা মুক্ত থাকেন।

তৃতীয়ত, কিছু কিছু জটিল মানবীয় আচরণ এবং অভ্যাস কোনােক্রমেই ভাষার মাধ্যমে বা কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি করে সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা মােটেই সম্ভব নয়। এ সমস্ত ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ উপযুক্ত কৌশল হিসেবে স্বীকৃত। যেমন- নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা উপদলের মূল্যবােধ ও কৃষ্টিগত আচার-আচরণ।

চতুর্থত, সামাজিক বিশেষ কিছু কিছু শ্রেণির আচরণ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণই একমাত্র কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন- শিশুদের আচরণ, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের আচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য পর্যবেক্ষণই উপযুক্ত কৌশল।

পঞ্চমত, পর্যবেক্ষণের একটি বিশেষ সুবিধা হলাে পর্যবেক্ষণীয় মানুষের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যক্তি বা দলের ইচ্ছা নির্ভর থাকে না। অর্থাৎ সাক্ষাৎকার, পরীক্ষণ, প্রশ্নপত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে গবেষককে উত্তরদাতার সঠিক সহযােগিতা ও সদিচ্ছার ওপর যতটা নির্ভরশীল থাকতে হয়, পর্যবেক্ষক সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতা ভােগ করে থাকেন।

ষষ্ঠত, পর্যবেক্ষণ যেহেতু মৌলিক ও সঠিক মানবীয় আচরণ সম্পর্কে তথ্য দিয়ে থাকে, সে কারণে পর্যবেক্ষণ যে কোনাে নতুন প্রকল্প গঠন কিংবা প্রচলিত প্রকল্প যাচাইয়ে অধিকতর সহায়ক।

পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাঃ পর্যবেক্ষণ তথ্য সংগ্রহের একটি প্রাথমিক ও মৌলিক কৌশল হলেও এর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও সমস্ত সীমাবদ্ধতা দূর করার বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা বিদ্যমান রয়েছে তবুও সাধারন কিছু দুর্বলতা পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি আজও কাটিয়ে ওঠতে পারেনি। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য সীমাবদ্ধতাগুলাে হলাে নিম্নরূপ-

নিয়ন্ত্রণের অভাবঃ প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বাভাবিক মাত্রায় আচরণ ও ঘটনা ধারণ করার প্রয়ােজনে পর্যবেক্ষক খুব কম পরিধিতেই তার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা বজায় রাখতে পারেন। ফলে বিভিন্ন বহিঃস্থ উপাদানের প্রভাব পর্যবেক্ষক এড়াতে সক্ষম হন না।

সংবেদনশীল বিষয়ে অনুসন্ধানের অক্ষমতাঃ ব্যক্তির একান্ত গােপনীয় বিষয়াদি যেমন- বিভিন্ন যৌন তৎপরতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ প্রায় সর্বাংশেই অসম্ভব। এক্ষেত্রে বরঞ্চ ডাক প্রশ্নপত্রই বর্তমানকালে সফল ব্যবহৃত কৌশল।

পরিমাণগত অসুবিধাঃ পর্যবেক্ষক প্রত্যয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন ঘটনা ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করে থাকেন প্রধানত এর গুণগত দিকগুলাে ধারণ করার মাধ্যমে। উপরন্ত পর্যবেক্ষণ একটি নমনীয় তথ্য সংগ্রহ কৌশল হওয়ায় বিরাট সংখ্যক তথ্য এ ক্ষেত্রে আহরণ করতে হয়। ফলে তথ্যের সঠিক শ্রেণিকরণ, সাংকেতিকরণ এবং সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে পরিমাপ এক দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দেখা দেয়।

ক্ষুদ্রাকৃতির নমুনাঃ পর্যবেক্ষণে সাধারণত সীমিত সংখ্যক ঘটনা বা মানবীয় আচরণের ওপর অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করতে হয়। একজন মাত্র সাক্ষাৎকার প্রহণকারির পক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিরাট সংখ্যক উত্তরদাতার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু একজন পর্যবেক্ষকের পক্ষে অধিকসংখ্যক ঘটনা বা আচরণের ওপর কাজ করা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনাে ক্রমেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।

অংশগ্রহণের সীমিত সুযােগঃ পর্যবেক্ষণের একটি বিশেষ প্রতিবন্ধকতা হলাে অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের সব ক্ষেত্রেই পর্যবেক্ষণীয় দলে সহজভাবে প্রবেশ করা কিংবা অংশগ্রহণ করা পর্যবেক্ষকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। কেননা এক্ষেত্রে দলীয় গ্রহণীয়তার প্রশ্ন বিদ্যমান। দল বা পর্যবেক্ষণীয় জনগােষ্ঠী যদি পর্যবেক্ষককে গ্রহণ না করেন তাহলে তাকে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হতে হয়।

গবেষকের পক্ষপাতদুষ্টতাঃ পর্যবেক্ষক বিশেষত অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণে নিজের আবেগ, অনুভূতি, মূল্যবােধ এবং পর্যবেক্ষণীয় ব্যক্তি বা দলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য সংগ্রহে ঝোঁক প্রবণ হয়ে পড়তে পারেন। উপরন্তু যথাযথ জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের অভাবেও এহেন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।

সামগ্রিক সীমাবদ্ধতাঃ কিছু কিছু সামাজিক ঘটনা বা আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনুসন্ধান করা প্রায় অসম্ভব। যেমন- জনমত যাচাই, দৃষ্টিভঙ্গি পরিমাপ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ ইত্যাদি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞানে যেসকল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে থাকে তার মধ্যে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি অন্যতম। কেননা, সমাজ গবেষণার একটি মৌলিক তথ্য সগ্রহ হিসেবে পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে বিবেচিত। যদিও পর্যবেক্ষণের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরেও সামাজিক বিজ্ঞানের উন্মেষ ও বিকাশে পর্যবেক্ষণই প্রধান ভূমিকা পালনকারি কৌশল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক