বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নীতিমালাঃ বিজ্ঞানী যে যৌক্তিক পদ্ধতিতে সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলি বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাধারণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তাকেই সাধারণ কথায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে। বস্তুত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই বিজ্ঞানের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা ও রক্ষাকারি উপাদান। অন্যভাবে বলতে গেলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মূলত সুসংবদ্ধ জ্ঞান প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচালিত কিছুসংখ্যক নীতির সমষ্টি। এ নীতিগুলাে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সক্ষম করে তােলে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্রায় সকল বিজ্ঞানীই এ সমস্ত সাধারণ নীতি অনুসরণ করে চলেন। নিম্নে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নীতিমালাগুলাে বর্ণনা করা হলাে-
(১) কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান (Operational Definition): বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নীতিমালাগুলাের মধ্যে কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষণাধীন বিষয় বা অবস্থাকে এমন কার্যকরভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যাতে করে তা পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপযােগ্য হয়ে ওঠে।
(২) সার্বিকীকরণ (Generality): এ ক্ষেত্রে বিষয় বা অবস্থার নির্দিষ্ট কোনাে অংশের পরিবর্তে সার্বিক দিকটিকেই বিমূর্তভাবে তুলে ধরা হয়। অর্থাৎ বিশেষে সীমাবদ্ধ না রেখে বরঞ্চ সাধারণে এর সত্যতা উপস্থাপন করা হয়; বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত সর্বজনীন। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত সামাজিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তাবলি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান প্রদত্ত সিদ্ধান্তের মতাে ততটা সুনিশ্চিত নয়। কেননা সামাজিক বিষয় অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। তাই সামাজিক গবেষণালব্ধ সকল সিদ্ধান্তের বিশ্বজোড়া সর্বজনীনতা নেই বললেই চলে। তবে সীমিত ক্ষেত্রে হলেও সামাজিক গবেষণা তুলনামূলকভাবে তার সিদ্ধান্ত সাধারণীকরণের চেষ্টা করে। এবং এর ফলশ্রুতিতে সমাজভেদে বিভিন্ন সাধারণ অবস্থার প্রকৃতি সর্বজনীন করা কিছু কিছু সম্ভবপর হয়েছে। পরিমাপের দুর্বলতাই সমাজ গবেষককে সিদ্ধান্ত সাধারণীকরণে নমনীয় করে রাখে।
(৩) নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ (Controlled Observation): পরীক্ষাধীন বিষয় সম্পর্কে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তের নির্ভরযােগ্যতা ও যথার্থতা বিশ্লেষণাধীন বিষয় বা অবস্থার বিভিন্ন পরিবর্তন পর্যবেক্ষেণের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রয়ােগ করা হয়। আবার এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিস্তারকারি আনুষঙ্গিক অবস্থাগুলােকে নিয়ন্ত্রণ করে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়।
(৪) পরিমাপ (Measurement): বিজ্ঞানের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলাে তার প্রাপ্ত সত্যের পরিমাপযােগ্যতা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতাে সামাজিক গবেষণা তার সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারে না। তবে চুলচেরা পরিমাপ না করতে পারলেও তুলনামূলক পরিমাপ করা সমাজ গবেষকের পক্ষে সম্ভব হয়ে থাকে। সত্যিকার অর্থে সমাজ গবেষণার প্রাথমিক ও প্রধান দুর্বলতাই হচ্ছে মাত্রাগত পরিমাপে অপারগতা। অর্থাৎ কতটুকু দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেলে কতটুকু অপরাধপ্রবণতা বাড়বে তা সমাজ গবেষক পরিমাপ করতে পারেন না। তবে দারিদ্র্য যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করে এটা বলা সম্ভব।
(৫) পর্যবেক্ষণের পুনরাবৃত্তি (Repeated Observation): পরীক্ষণাধীন বিষয় সম্পর্কে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তের নির্ভরযােগ্যতা ও যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য একই ধরনের পরীক্ষণ কাজ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বারবার পরিচালনা করা হয়। বিভিন্ন নমুনায় একই ধরনের ফলাফল প্রাথমিক ফলাফলের সত্যতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
(৬) নিশ্চিতকরণ (Confirmation): পরীক্ষিত সিদ্ধান্তটি প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ বিভিন্ন উপায়ে ব্যাখ্যা করে এর সঠিকতা সম্পর্কে বিজ্ঞানী নিশ্চিত হতে চান। এ ক্ষেত্রে তিনি বিষয়সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ অবস্থার মধ্যকার কার্যকারণ সম্পর্ক যাচাইয়ের প্রয়াস পান।
(৭) সঙ্গতিবিধান (Consistency): গৃহিত সিদ্ধান্ত সবক্ষেত্রে যাতে সঙ্গতিপূর্ণ হয় সেদিকে বিজ্ঞানী সচেষ্ট থাকেন। অর্থাৎ প্রাপ্ত সত্যের ব্যাখ্যা অভ্যন্তরীণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এর মাঝে কোনাে প্রকার ছন্দপতন বা উল্লম্ফন নেই তা বিজ্ঞানী নিশ্চিত করেন।
পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ঘটনার বর্ণনা ও ব্যাখ্যাদানের নিমিত্তে কিছু বিধিমালার আবশ্যকতা আছে বৈকি। কেননা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মূলত সুসংবদ্ধ জ্ঞান প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচালিত কিছু সংখ্যক নীতির সমষ্টি। আর এই সকল নীতিই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির স্বকীয়তা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে। এই সকল নীতিমালাকে অবলম্বন করেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
0 মন্তব্যসমূহ