সামাজিক স্তরবিন্যাস সংক্রান্ত মতবাদসমূহ আলােচনা কর


প্রশ্নঃ সামাজিক স্তরবিন্যাস সংক্রান্ত মতবাদসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, সামাজিক স্তরবিন্যাসের তত্ত্বসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, কার্ল মার্কস ও ম্যাক্স ওয়েবারের সামাজিক স্তরবিন্যাস সংক্রান্ত মতবাদ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সামাজিক স্তরবিন্যাস আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম বিষয়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও দার্শনিকগণ সামাজিক স্তরবিন্যাসের ওপর বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী T.B. Bottomore এই মতামতগুলােকে নিম্নের তিন ভাগে ভাগ করেছেন-

(i) মার্কসীয় মতবাদ (Marxist Theory)
(ii) ওয়েবারের মতবাদ (Webers Theory)
(iii) ক্রিয়াবাদী মতবাদ (The Functionalist View) নিম্নে এই মতবাদগুলাে আলােচনা করা হলাে:

Marxist Theory (দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব): বিশিষ্ট জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস তার Communist Manifesto গ্রন্থে বলেছেন, The history of all hither to existing societies is the history of class Struggle." অর্থাৎ সকল মানবসমাজের ইতিহাস হলাে শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস এবং মার্কসীয় সমাজতত্ত্বে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হলাে শ্রেণি সংগ্রাম। তিনি আরাে বলেছেন, ভূসম্পত্তির আবির্ভাবের সাথে সাথেই মানবসমাজে শ্রেণির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপঃ Agrarian society তে দুটি শ্রেণির কথা উল্লেখ করেছেন। যথা:
(i) Land Owners (ভূমি মালিক)।
(ii) Tenants (প্রজা বা ভাড়াটিয়া)

কার্ল মার্কসের মতে, আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে প্রধান দুটি শ্রেণি ছিল। প্রথমত, পুঁজিপতি শ্রেণি এবং দ্বিতীয়ত, শ্রমিক শ্রেণি। এই পুঁজিপতি শ্রেণিই হলাে দেশের শাসক শ্রেণি যারা শ্রমিকদের ওপর নিপীড়নের মাধ্যমে মুনাফা লাভের চেষ্টা করে। কার্ল মার্কসের মতে, সমাজে যে দুটি প্রধান শ্রেণি রয়েছে তারও কিছু উপশ্রেণি আছে। যেমনঃ

(১) Basic Class: এর মধ্যে Owning Class কে উৎপাদন উপায়ের মালিক এবং Non-owning class কে উৎপাদন উপরের মালিকানা থেকে বঞ্চিত বলা হয়। কার্ল মার্কস উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরাে দুটি শ্রেণির কথা উল্লেখ করেছেন। যথা: (i) Capitalist অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণী বা Bourglotsic, (ii) Labour অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণী বা Proletariate

(২) Non Basic Class: সমাজে উৎপাদন উপায়ের মালিকানা ছাড়া অন্য শ্রেণিগুলাে হচ্ছে Non-Basic Class. কার্ল মার্কসের তার Das Kapital গ্রন্থের অসমাপ্ত তৃতীয় খণ্ডে শ্রেণি সম্পর্কিত বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। কার্ল মার্কসের সেখানে তিনটি শ্রেণির কথা উল্লেখ করেন। কার্ল মার্কসের ত্রিমাত্রার শ্রেণির আলােচনায় দুটি মডেল রয়েছে।

প্রথমত, আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজের ৩টি শ্রেণি হচ্ছে -
(১) ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও মূলধনের মালিকানা এরা নিয়ন্ত্রণ করে।
(২) শ্রমিক শ্রেণিঃ পণ্য উৎপাদনে এরা শ্রম সরবরাহ করে।
(৩) ভূ-স্বামীঃ এরা ভূ-স্বামীর স্বত্বের অধিকারী।

দ্বিতীয়ত, তিনি পুঁজিপতিদের দুটি ভাগে বিভক্ত করেন।
(১) বুর্জোয়া ও এরা উৎপাদনযন্ত্রের মালিক এবং মজুরির বিনিময়ে শ্রমিক খাটায়।
(২) পেটিবুর্জোয়াঃ এরা উৎপাদন যন্ত্রের মালিক এবং নিজেরাও পণ্য উৎপাদনে খাটে।

কার্ল মার্কসের শ্রেণি বিভাজনে যেসকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তা নিম্নরূপ-
(i) উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রতিটি শ্রেণি একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে।
(ii) উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানার ভিত্তিতেই শ্রেণির উদ্ভব হয়।
(iii) প্রত্যেক সমাজে শ্রেণি সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী।

কার্ল মার্কস সর্বহারা শ্রেণির সচেতনতা সম্পর্কে দু’টি উক্তি উল্লেখ করেনঃ
(১) Class in Itself: যেখানে সর্বহারা শ্রেণি সচেতনহীন এবং এদের আর্থিক অবস্থা প্রায় একই রকম, সেখানে শ্রমিকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব হতে পারে।
(২) Class for Itself: শ্রেণি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শােষণের অবসান ঘটানাের জন্য শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে অনুকূলে বিপ্লবী মানসিকতা গড়ে ওঠলে তখন তাদের Class for It self বলা হয়।

কার্ল মার্কস মনে করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত শ্রেণি সচেতনতা গড়ে না ওঠবে ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রেণি যথার্থ বলে পরিণত হতে পারে না। তিনি মূলত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতির ওপর নির্ভর সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে আলােকপাত করেছেন। আবার একই সাথে আগামী দিনের শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় পন্থা, প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে পুঁজিবাদী সমাজের অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস এবং সে স্থলে শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।

সমালােচনাঃ (১) সর্বহারা ও বুর্জোয়ার শ্রেণিবিন্যাসই সমাজ নয়। (২) মার্ক্সের আদিম সাম্যবাদ তত্ত্ব শুধুই কাল্পনিক। (৩) রাষ্ট্রের পতন কখনাে শ্রেণি সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি হতে পারে না। (৪) মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ি শ্রমিক শ্রেণি শুধু বিপ্লবের জন্যই সংঘটিত হয় না। (৫) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে ধনতান্ত্রিক সমাজপ্রতিষ্ঠা বাধ্যতামূলক নয়। যেমন: চীন, রাশিয়া ইত্যাদি। 

কার্ল মার্কসের সামাজিক স্তরবিন্যাস তত্ত্ব সমালােচিত হলেও এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক আলােচনা। এই তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ-মানব ইতিহাসে শ্রেণিহীন সমাজ কখনই দেখা যায়নি।

Weber's Theory (ওয়েবারের মতবাদ): Karl Marx তার সামাজিক স্তরবিন্যাসের তত্ত্বটি প্রকাশ করার প্রায় কয়েক দশক পর বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার তার সামাজিক স্তরবিন্যাসের নতুন তত্ত্ব প্রকাশ করেন। ম্যাক্স ওয়েবার তিন দিক থেকে সামাজিক স্তরবিন্যাসকে বিশ্লেষণ করেছেন। যথা-Class, Status এবং Power. এজন্য Weber-এর তত্ত্বটি Multidimensional Theory নামে পরিচিত।

Class: ম্যাক্স ওয়েবার Class বলতে Property এবং Lack of Property কে বুঝিয়েছেন। তার মতে, সমাজে সম্পত্তির মালিকরা একটি শ্রেণি এবং সম্পত্তিহীনরা আরেকটি শ্রেণি। ম্যাক্স ওয়েবার শ্রেণিকে নিম্নোক্ত ২ ভাগে ভাগ করেন। যথা- (১) ধনাত্মক বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণি। (২) ঋণাত্মক বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণি।

(১) ধনাত্মক বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণিঃ তিনি এর দ্বারা ক্ষমতাভােগী/পুঁজিপতি মালিকানাকে বুঝিয়েছেন।

(২) ঋণাত্মক বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণিঃ তিনি এর দ্বারা বিশেষ ক্ষমতা/প্রজা শ্রেণিকে বুঝিয়েছেন।

Status: Status বলতে Weber life style. Social prestige. Social Honour ইত্যাদিকে বুঝিয়েছেন। তার মতে, প্রত্যেক মানুষেরই কম-বেশি সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে।

Power: ম্যাক্স ওয়েবার মূলত Power বলতে Political Power কে বুঝিয়েছেন। তার মতে, ক্ষমতার উৎস হচ্ছে দুটিঃ (১) Controlover Human Resource. (২) Controlover Material Resource.

সমালােচনাঃ Max Weber-এর তত্ত্বটি সামগ্রিকভাবে সামাজিক স্তরবিন্যাস তত্ত্বকে উন্নতিতে সহায়তা করেছে। কিন্তু তিনি স্তরবিন্যাসের যে ৩টি মাত্র উল্লেখ করেছেন তার আলােকে সামাজিক আচরণের নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা দেয়ার প্রয়াস পাননি।

The Functionalist View (ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গি): মার্কস মনে করেন, স্তরবিন্যাস মূলত অবিচার ও শােষণের প্রতীক। তার মতে, সামাজিক স্তরবিন্যাসের ভিত্তি হিসেবে সামাজিক বৈষম্য খুবই অস্থায়ী এবং এর কোনাে প্রয়ােজনীয়তা নেই। ১৯৪৫ সালে Kingsley Davis এবং Wilbert Moore সামাজিক স্তরবিন্যাসের ওপর একটি ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব। প্রকাশ করেন, যার মূল বক্তব্য হলাে-
(১) তারা স্তরবিন্যাস বলতে খ্যাতি এবং সম্পদের অসম বণ্টনকে বুঝিয়েছেন।
(২) সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার একটি সীমাবদ্ধতা আছে এবং তাই সমাজে অসমতা অনিবার্য।
(৩) স্তরবিন্যাস সব সমাজেই সর্বজনীনভাবে সর্বত্র সত্য ও বাস্তব।
(৪) পারদর্শী ও বিশেষজ্ঞরা সামাজিক স্তরের উচ্চ স্থান পাবে।
(৫) সমাজের দায়িত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ কাজে দক্ষ ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করতে হলে সমাজকে অবশ্যই স্তর বিন্যাস মেনে নিতে হবে।

পরিশেষঃ উপযুক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, আদি হতে বর্তমান সমাজ পর্যন্ত সব মানবসমাজই স্তরায়িত স্তরবিন্যাসের অযােগ্য কোনাে সমাজ অদ্যাবধি দেখা যায়নি। এমনকি সমাজতান্ত্রিক সমাজেও আয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা, শিক্ষা ইত্যাদির বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক