নৈতিক নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে? নিয়ন্ত্রণের শ্রেণিবিভাগ আলােচনা কর

প্রশ্নঃ নৈতিক নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে? নিয়ন্ত্রণের শ্রেণিবিভাগ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ বেন্থাম সার্বিক বা সাধারণ সুখ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কাম্য আচরণের রূপসমূহের প্রয়ােগের জন্য উদ্দেশ্য হিসেবে সুখ-দুঃখের বিভিন্ন রূপ হিসেবে যেসব যুক্তির উপস্থাপন করেছেন সেগুলােকেই নৈতিক নিয়ন্ত্রণ বলে। বেন্থামের এই নিয়ন্ত্রণ বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ নামে পরিচিত।

নৈতিক নিয়ন্ত্রণঃ নিয়ন্ত্রণ বলতে এখানে প্রধানত অনুমােদনকে বােঝায়। তাই রাষ্ট্রের নিয়মাবলিকে অনুমােদন বা সক্রিয় করতে, অর্থাৎ এ নিয়মাবলিকে লঙ্ঘনের সাথে শাস্তি জড়িত অর্থে নিয়ন্ত্রণ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উপযােগবাদী লেখকরা মনে করেন যে, উদ্দেশ্য বলতে সুখের আশা এবং দুঃখের ভীতিকে বুঝানাে হয়ে থাকে। এই সুখ বা দুঃখ নানাভাবে প্রতিভাত হয়ে থাকে। সামাজিক অনুমােদনের ফলে দুঃখ এবং আমাদের স্বশ্রেণির জীবের অনুমােদনের ফলে সুখ দেখা যায়। একইভাবে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নিয়মাবলি পালন ও ভঙ্গ করার ক্ষেত্রেও সুখ-দুঃখের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

নিয়ন্ত্রণের শ্রেণিবিভাগঃ উপযােগবাদীদের নৈতিকতা সম্পর্কীয় আলােচনা থেকে দেখা যায় যে, নিয়ন্ত্রণ প্রধানত দু'ধরনের। যেমন- (ক) বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ এবং (খ) অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ। নিম্নে এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হলাে-

(ক) বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণঃ অনেক সময় আমরা পুরস্কারের আশায় এবং শাস্তির ভয়ে ভীত হয়েও নৈতিক বিধি-বিধান পালন করি। নৈতিকতা পালনের পদ্ধতিকেই বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তার মানে যে বাইরের শক্তি বা বিধি বিধান আমাদের কর্মধারা নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ বলা হয়। বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণকে বেন্থাম ৪ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-

১. প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণঃ মানুষ যে প্রাকৃতিক পরিবেশে লালিত পালিত হয় সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষের উপর কতকগুলাে বিধি-নিষেধ আরােপ করে থাকে। প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ লঙ্ঘন করলে মানুষের জীবন দুঃখ কষ্ট, ব্যথা-বেদনা ইত্যাদিতে ভরে উঠে। সুন্দর জীবন, দীর্ঘ জীবন প্রভৃতি পুরস্কার এবং অপ্রীতিকর জীবন, স্বল্প জীবন, রােগ-কষ্ট ইত্যাদি শাস্তি প্রদান করে প্রকৃতি মানুষকে তার প্রদত্ত নিয়ন্ত্রণ পালন করতে বাধ্য করে। নিজের সুখের সাথে সাথে অপরের। সুখের দিকেও আমাদের নজর দেয়া উচিত।

২. রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণঃ রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সার্বিক কল্যাণই রাষ্ট্রের মূল কথা। নাগরিকদের সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্র তার জনগণের উপর নিয়ম বা বিধি-বিধান নির্দিষ্ট করে থাকে। রাষ্ট্রের অধীন জনগণ রাষ্টের এই বিধি বিধান পালন করে থাকে। নাগরিক যখন রাষ্ট্র প্রদত্ত বিধি বিধান পালন না করে তখন যে শাস্তির মুখােমুখী হয়।

৩, লৌকিক নিয়ন্ত্রণঃ লৌকিক নিয়ন্ত্রণ যা প্রায়শ সামাজিক হয়ে থাকে-মনে করে যে, প্রত্যেকটি সমাজেই কতকগুলাে রীতি-নীতি থাকে। অসৎ কর্মের জন্য নাগরিকদের শাস্তি দেওয়া হয় এবং সৎ কর্মের জন্য নাগরিকদের পুরস্কৃত করা হয়। এভাবে সামঞ্জস্য বিধান করে আমরা একটি সুখী সমাজ কাঠামাে তৈরি করেন।

৪, ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণঃ মানব প্রকৃতির পর্যালােচনা থেকে জানা যায় যে, প্রায় সব মানুষই কোনাে না কোনাে ধর্মের আওতায় বাস করে এবং সেই ধমের বাধ-বিধান পালন করার চেষ্টা করে। প্রতিটি ধর্মের মূল কথা হলো সৎ কাজ করলে শান্তি আসবে এবং অসৎ কর্ম করলে শাস্তি অনিবার্য। ধর্মভীরু ব্যক্তিরা মনে করে যে, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণকে ফাকি দেওয়া গেলেও সৃষ্টিকর্তাকে ফাঁকি দেওয়া কখনাে সম্ভব নয়।

৫, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণঃ মিল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ বলতে মানুষের বিবেককে বুঝিয়েছেন। তিনি অভিমত পােষণ করেন যে, মূলত আমাদের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণই বিবেকের নির্দেশ বা শাসন। এই বিবেক আমাদের মনে অপর মানুষের জন্য সহানুভূতি ও সমবেদনার ভাব জাগিয়ে তােলে এবং এই বিবেক দ্বারাই আমরা নিয়ন্ত্রিত হই। এই বিবেকের শাসনের ফলে আমরা নৈতিকতার ক্ষেত্রে নিজের সুখের সাথে সাথে অপরের সুখ অনুসন্ধান করে থাকি।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মিলের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণও পুরােপুরি গ্রহণ করা যায় না। মিল বিবেকের প্রাধান্য দিয়ে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, অনুশােচনা নামক আবেগ-অনুভূতিকেই পরিণামে স্বীকার করে নিয়েছেন। উচিত বা অনুচিত সম্পর্কে তিনি কোনাে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখতে পারেন নি। নিছক আবেগ-অনুভূতি একটা অন্ধ অনুভূতি ছাড়া কিছুই না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক