দর্শনের সাথে ধর্মের সাদৃশ্য আলােচনা কর


প্রশ্নঃ দর্শন কী? দর্শনের সাথে ধর্মের সাদৃশ্য আলােচনা কর।
অথবা, দর্শন কাকে বলে? দর্শনের সাথে ধর্মের মিল তুলে ধর।

ভূমিকাঃ দৈনন্দিন জীবনে মানব মনে প্রকৃতির অপার রহস্য ও জীবনের অজস্র জটিলতা। বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। আর এ জিজ্ঞাসা থেকেই জন্ম নেয় দর্শন। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। তাই সে এসব রহস্য ছিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি, জীবনের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্যকেও আবিষ্কার করেছে। আর এজন্যই দর্শন একটি সর্বাত্মক বিষয়। দর্শন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দৃশ ধাতু থেকে। বাংলা ভাষায় দৃশ ধাতুর অর্থ হলাে দেখা। দৈনন্দিন জীবনে দেখা বলতে আমরা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণকে বুঝি। কিন্তু এখানে দেখা মানে চাক্ষুষ দেখা নয়। দর্শন হচ্ছে জীব ও জগতের স্বরূপ উপলব্ধি।

শব্দগত অর্থে দর্শনঃ দর্শনটি শব্দটির ইংরেজি “Philosophy” গ্রিক ভাষা থেকে উদ্ভূত। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক পিথাগােরাস “Philosophy” কথাটিকে “জ্ঞানানুরাগ' অর্থে ব্যবহার করেন। “Philosophy” শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Philos' এবং "Sophia" থেকে উদ্ভূত হয়েছে। 'Philos' শব্দের বাংলা অর্থ অনুরাগ এবং 'Sophia' শব্দের অর্থ জ্ঞান। অর্থাৎ “Philosophy” শব্দের ধাতুগত অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ। খ্রিষ্টপূর্ব যুগে সক্রেটিস ও প্লেটো থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পাশ্চাত্য জগতের ধারণা হলাে- দর্শনের প্রধান কাজ জ্ঞান আহরণ।

দর্শনের সংজ্ঞাঃ দর্শনের সংজ্ঞা চট করে দেওয়া সম্ভব নয়। যুগে যুগে বিভিন্ন দার্শনিক দর্শনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। এসব সংজ্ঞা পর্যালােচনা করলে যে সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, প্রত্যেক দার্শনিকই জগৎ জীবনের ব্যাখ্যা, জগতের সংগে জীবনের সম্পর্ক, স্রষ্টার সংগে সৃষ্টির সম্পর্ক ইত্যাদির ওপর গুরুত্বারােপ করেছেন।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ দর্শনের পরিধি এতই ব্যাপক যে এর সঠিক সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। তবুও বিভিন্ন দার্শনিক দর্শনের সংজ্ঞা প্রদান করেন।

গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ভাষায়, চিরন্তন এবং বস্তুর মূল প্রকৃতির জ্ঞান অর্জন করাই দর্শনের লক্ষ্য।

এরিস্টটলের মতে, আদি সত্তা স্বরূপতঃ এবং এ স্বরূপের অঙ্গীভূত যে সব বৈশিষ্ট্য তার অনুসন্ধান করে যে বিজ্ঞান তাই হলাে দর্শন।

মারভিনের মতে, দর্শন অর্থ সত্যের প্রতি অনুরাগ, সব সত্য যার অন্তর্ভুক্ত এমন জ্ঞানের পূর্ণভাণ্ডার, যাতে যাবতীয় সত্য এক মহান অখণ্ডতার মধ্যে সুবিন্যস্ত।

হার্বার্ট স্পেন্সার বলেন, বিশৃঙ্খল জ্ঞান নিম্নমানের জ্ঞান। বিজ্ঞান হলাে আংশিক একীভূত জ্ঞান। বিভিন্ন বিজ্ঞানের সাধারণ সত্যগুলােকে অন্তর্নিবিষ্ট ও দৃঢ়ীকৃত করার ফলে যে সম্পূর্ণ ঐক্য বা জ্ঞান তাই দর্শন।

দার্শনিক কানিংহাম বলেন, মানুষ দার্শনিক হবে কি না, তা কোননা প্রশ্ন নয়; প্রশ্ন হলাে ভালাে এবং মন্দ এই দুই দর্শনের মধ্যে একটিকে নির্বাচন করা।

দার্শনিক শেলিং বলেন, জগৎ ঠিক কি হলে মন একে বুঝতে পারবে এবং মন ঠিক কি হলে জগৎ একে বুঝতে পারবে এটি নির্দিষ্ট করার চেষ্টাই দর্শন।

আমাদের অভিমতঃ উপরের সংজ্ঞাগুলাে আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, দর্শন এমন এক অনুশীলনের দিকনির্দেশনা দান করে, যার মধ্যে জ্ঞানার্জনের প্রায় সবগুলাে শাখাই অনিবার্যভাবে অন্তর্গত। দর্শন হচ্ছে জীবন ও জগৎকে ঘিরে উদ্ভূত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান। এ কারণে দর্শনকে জগৎ ও জীবনের সামগ্রিক ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন বলে অভিহিত করা হয়।

দর্শনের সাথে ধর্মের সম্পর্কঃ দর্শনের সাথে ধর্মের সম্পর্ক আলােচনা করতে হলে দর্শন ও ধর্মের স্বরূপ, সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য এবং পরস্পরের মধ্যে নির্ভরশীলতা প্রভৃতি উল্লেখ করা প্রয়ােজন। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হলােঃ

দর্শনের স্বরূপঃ আক্ষরিক অর্থে দর্শন হচ্ছে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা সত্যের অনুসন্ধান। দর্শন যুক্তি ও চিন্তার মাধ্যমে পরম সত্তা, জগৎ-জীবনের সাথে জড়িত সমস্যাবলির সূক্ষ্ম এবং যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দান করে। দর্শন জীবন ও জগতের মূল্য অবধারণ করে।

ধর্মের স্বরূপঃ বিশ্বাসই ধর্মের মূলভিত্তি। ধর্ম হলাে এমন এক অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস, যে শক্তি বিশ্বের সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে রয়েছে একজন সৃষ্টিকর্তা। যিনি বিশ্বের সব কিছুরই মালিক। মানুষ তার সান্নিধ্য লাভের আশায় তার কাছে ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা অর্পণ ও নিজেকে সমর্পণ করে থাকে। জাকসের মতে, অতি উল্কষ্টের প্রতি অনমনীয়ভাবে আনুগত্য প্রকাশই হচ্ছে ধর্মের জীবনীশক্তি।

দর্শন ও ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্যঃ দর্শন ও ধর্ম উভয়েরই উদ্দেশ্য এ বিশ্বজগতের রহস্য উদঘাটন, বিশ্ব পরিকল্পনায় মানুষের স্থান, দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ণয়ের ব্যাখ্যা। উভয়ই সার্বিক নীতি সম্পর্কে আলােচনা করে। স্রষ্টা, সৃষ্টি, আত্মার অমরত্ব ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয় দর্শন নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে আলােচনা করে। সুতরাং ধর্ম ও দর্শন পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত।

ধর্ম ও দর্শন একে অপরের পরিপূরকঃ উপরােক্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ধর্ম ও দর্শন একে অপরকে সাহায্য প্রদান করে। ধর্মের অনুভূতিলব্ধ জ্ঞান দর্শনের মাধ্যমে যুক্তিসিদ্ধ হয়ে অপরের কাছে বােধগম্য হয়। আবার দর্শনের সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণাত্মক যুক্তি যখন মানুষকে পরম সত্তা সম্পর্কে সন্দিহান করে তােলে তখন সে ধর্মের মাধ্যমে বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করে। এভাবে ধর্ম দর্শনের গতিধারাকে অব্যাহত রাখে। সুতরাং ধর্ম ও দর্শন একে অপরের পরিপূরক।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দর্শন ও ধর্মের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। বিষয়বস্তুগতভাবে আমরা দেখেছি যে, দর্শন ও ধর্ম উভয়ই জীবন ও জগতের রহস্য উদঘাটন করে চরম সত্যকে আবিষ্কার করতে চায়। দর্শন যদি নিরপেক্ষ হয় এবং ধর্ম যদি অন্ধ গোঁড়ামির প্রভাবমুক্ত থাকে তাহলে উভয়ে জগতের রহস্যকে সুষ্ঠুভাবে উন্মােচন করতে পারে। পাশ্চাত্যের মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ তাই ধর্ম ও দর্শনকে এক ও অভিন্ন মনে করেন। সুতরাং দর্শন ও ধর্মের সম্পর্ক খুবই নিবিড়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক