রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যায়নে গােষ্ঠীতত্ত্বের কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যায়নে গােষ্ঠীতত্ত্বের কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা বর্ণনা কর।
অথবা, সমালােচনাসহ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গােষ্ঠীতত্ত্বের কার্যকারিতা আলােচনা কর ।

ভূমিকাঃ রাজনীতি অধ্যয়নে বা বিশ্লেষণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতি স্বীকৃত হয়েছে। এক সময়ে গতানুগতিক পদ্ধতিকে সর্বোত্তম পদ্ধতি বলে স্বীকার করা হতাে। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের অন্যতম আধুনিক পদ্ধতি হলাে গ্রুপ তত্ত্ব। ১৯০৮ সালে প্রকাশিত 'The Process of Govt.' গ্রন্থে Arthur F. Bentley সর্বপ্রথম এই পদ্ধতি প্রচার করেন। অবশ্য Bentley-এর পূর্বে আরব রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ইবনে খালদুন তার ‘আল মুকাদ্দমা' গ্রন্থে গ্রুপ সম্পর্কে আলােচনা করেন। মূলত আমেরিকার সমাজের দ্বন্দ্ব ও প্রতিযােগিতা থেকেই গ্রুপ তত্ত্বের উদ্ভব হয়।

গােষ্ঠীতত্ত্ব বা গ্রপ তত্ত্বের সংজ্ঞাঃ প্রচলিত অর্থে গ্রুপ হচ্ছে একটি জনগােষ্ঠী, যারা কোনাে বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য একত্রে মিলিত হয়। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের যে জনসমষ্টি একত্রে মিলিত হয়, তাদেরকে রাজনৈতিক গ্রুপ বলে। গ্রুপ তত্ত্বের প্রবক্তা Arthur F. Bentley-এর মতে ব্যক্তির স্বতন্ত্র কোনাে অস্তিত্ব নেই। তারা গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি যে গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত সে গ্রুপই তার স্বার্থ সংরক্ষণ করে। আবার কোনাে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে।

প্রয়ােগগত কার্যকারিতাঃ বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করা মানে Institutional Interest Group-কে বিশ্লেষণ করা। কোন পেশা বা বৃত্তিতে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ গ্রুপ গঠিত হয়। কতকগুলাের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসাধনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ গ্রুপের জন্ম হয়। বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগ্রুপগুলাের মধ্যে নিম্নলিখিত গ্রুপগুলাে প্রধান। (১) রাজনৈতিক দল, (২) আইনসভা, (৩) সামরিক বাহিনী, (৪) আমলাতন্ত্র। এটা ঠিক যে, আর্থ-সামাজিক দিক থেকে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগ্রুপগুলাে অধিক প্রভাবশালী। শাসনের ভূমিকায় আজ যারা সামরিক ও বেসামরিক আমলা তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে প্রাতিষ্ঠানিক গ্রুপকে।

১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে ২৪ বছর পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক কাঠামাের আওতাধীন বাংলাদেশ, নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানে বাংলাদেশের তৎকালীন বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এরপর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। এরপর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয় এবং পরবর্তীতে সামরিক সরকার দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। এরপর ১৪/১৫ বছর বাংলাদেশে চলছে প্রধান দুই সামরিক জান্তার শাসনকাল। আর এ অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জনগণ বসে থাকেনি।

১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত জনগণ এরশাদের ঘৃণ্য শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে তার পতন ঘটিয়েছে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বার বার সামরিক বাহিনী শাসন ক্ষমতায় এসেছে। তাদের স্বার্থে ও তাদের চাপে বার্ষিক বাজেটের একটা উল্লেখযােগ্য পরিমাণ তাদের পিছনে ব্যয় হচ্ছে। এ ছাড়া ১৯৭৫ সালের পর থেকে আমলারাও শক্তিশালী হয়ে ওঠতে থাকে। এরপর ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসে এবং ১৯৯৬-এর নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। এরপর দীর্ঘকাল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আ’লীগ বাংলাদেশের ক্ষমতায় আছে।

গ্রুপ তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা বা সমালােচনাঃ গ্রুপ তত্ত্বের উপযুক্ত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও এ তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নিম্নে এগুলাে আলােচনা করা হলাে-

(১) অস্পষ্টঃ গ্রুপ তত্ত্বে ব্যবহৃত গ্রুপ, সম্পর্ক, কার্য এ সকল ধারণার ব্যাখ্যা ও সুস্পষ্ট নয়। গ্রুপ তাত্ত্বিকেরা এগুলাের কার্যকর সংজ্ঞা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে এ তত্ত্বের মাধ্যমে রাজনীতির বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভবপর হয়নি।

(২) রাজনৈতিক ভূমিকাকে অবহেলাঃ সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মূল্যবোেধ ইত্যাদি সামাজিক শক্তিগুলাের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রুপ তত্ত্ব অবহেলা করেছে এবং অস্বীকার করেছে। ফলে এ তত্ত্বের মাধ্যমে রাজনীতির প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভবপর হয়নি।

(৩) সংকীর্ণমন্তব্যঃ গ্রুপ তাত্ত্বিকেরা স্বার্থ ও গ্রুপকে সমর্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তারা মনে করেন যে, প্রতিটি স্বার্থই গ্রুপে সংগঠিত ও প্রতিফলিত হয়- কিন্তু এরূপ মন্তব্য সঠিক নয়।

(৪) পরিধি সংকীর্ণঃ এই তত্ত্ব কেবল গ্রুপ নিয়ে অধ্যয়ন করে এবং গ্রুপের সদস্যবৃন্দই অধ্যয়নের বিষয়। কিন্তু সমাজের অধিকাংশ লােকই গ্রুপে সংগঠিত নয়। যেহেতু এ তত্ত্ব গ্রুপ বহির্ভুত সমাজকে অধ্যয়ন করে না, যেহেতু এর পরিধি সংকীর্ণ। গােষ্ঠীর কাঠামাের কথা বলেছেন যেগুলাে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলােচনা করা হয়েছে। উক্ত আলােচনা সত্ত্বেও আমরা এখন দেখবাে বাংলাদেশের রাজনীতি কোন গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত কিনা।

(১) সমিতিবদ্ধ স্বার্থগােষ্ঠীঃ এ গ্রুপে বিশেষ ব্যক্তিসমূহের স্বার্থ প্রতিফলিত হয়। এগুলাে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ এবং সর্বক্ষণ কর্ম দ্বারা পরিচালিত হয়। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের গ্রুপ গ্রহণযােগ্য নয়। বাংলাদেশে এ ধরনের গ্রুপের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন, ধর্মীয় সংস্থা, বণিক সমিতি উল্লেখযােগ্য।

(২) অসমিতিবদ্ধ স্বার্থ গােষ্ঠীঃ এ গ্রুপগুলাের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অত্যন্ত অনিয়মিত ও অনেকটা সুপ্ত। এ ধরনের স্বার্থ গ্রুপে ব্যক্তিগত চাপ ও প্রভাব কার্যকর থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ গ্রুপ মাঝে মাঝে দেখা দিলেও এটা সবসময় দেখা যায় না।

(৩) প্রাতিষ্ঠানিক গােষ্ঠীঃ এই গ্রুপগুলাে নিজেদের স্বার্থ ও মঙ্গলসাধন ছাড়াও অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনে তৎপর। বাংলাদেশের স্বার্থগ্রুপগুলাে যেমন- আইন সভা, আমলা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল, সামরিক বাহিনী প্রভৃতি গ্রুপগুলাের সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে তৎপর থাকে। স্বার্থগ্রুপ হিসেবে এদের ভূমিকা প্রতিফলিত হয়।

(৪) বিচ্ছিন্ন স্বার্থ গােষ্ঠীঃ ভাবাবেগপ্রসূত এ গ্রুপগুলাে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে। মাঝে মাঝে এ গ্রপ দেখা দিলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবসময় এরুপ দেখা যায় না। তবে '৯০-এর গণআন্দোলনে এ গ্রুপ বেশ জোরালাে ভূমিকা রাখে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রুপ তত্ত্বের কিছু সমালােচনা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক রাজনীতি অধ্যয়নে গ্রুপ তত্ত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন গ্রুপের পারস্পরিক সম্পর্ক, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ও অগ্রগতির স্বরূপ লাভ করা যায়। তা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলােতে এ তত্ত্ব বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক