কনফুসিয়াসের দর্শনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর। তার দর্শনকে কী রাজনৈতিক ও নৈতিক দর্শন বলা যায়?


প্রশ্নঃ কনফুসিয়াসের মতবাদ বিশ্লেষণ কর।
অথবা, কনফুসিয়াসের দর্শনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর। তার দর্শনকে কী রাজনৈতিক ও নৈতিক দর্শন বলা যায়?

ভূমিকাঃ প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে যে সকল দার্শনিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন, তাদের মধ্যে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন একজন নৈতিক দার্শনিক। ছােটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু ও বুদ্ধিদীপ্ত। অতঃপর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার দার্শনিক জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়। ফলে তিনি অতিমাত্রায় জ্ঞান চর্চায় মগ্ন হন। তার দর্শনের উদ্দেশ্য ছিল চীনের প্রাচীন প্রথায় ফিরে গিয়ে সমাজকে রক্ষা করা। তিনি জনগণকে নৈতিক জ্ঞান ও সদাচার পালনের শিক্ষা দিতেন। এজন্য তাকে নৈতিক দার্শনিক বলা হয়ে থাকে।

কনফুসিয়াসের জীবনীঃ চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নিম্নে আলােচনা করা হলাে-

(১) জন্ম ও পরিচয়ঃ কনফুসিয়াস ৫৫১ খ্রিঃ পূর্ব চীনের লু রাজ্যে (বর্তমান সানটুং) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কুয়াঙ্গ ছিলেন একজন সৈনিক। প্রচুর সম্পদের অধিকারী না হলেও কুয়াঙ্গ পরিবারের বেশ সামাজিক মর্যাদা ছিল।

(২) কর্মজীবনঃ শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে কনফসিয়াস কর্মজীবনে যােগ দেন। অতঃপর পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি ‘লু' রাজ্যের ডিউকের অধীনে কয়েক বছর রাজসেবায় নিয়ােজিত ছিলেন। কিন্তু তার মতাদর্শে না মেলায় তিনি এ চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে চীনের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। তার আশা চীনের সরকার তার আদর্শ গ্রহণ করবে, কিন্তু তা হয়নি। পরবর্তীকালে চীনের বিভিন্ন প্রদেশ তাকে চাকরি গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেও তিনি কোথাও চাকরি গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না।

(৩) তার রচনাবলীঃ ব্যক্তিজীবনে কনফুসিয়াস ছিলেন নৈতিক ও মানবতাবাদী। তাই তার লেখায় মানব সমাজের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশ পায়।

(8) কনফুসিয়াসের চরিত্রঃ প্রাচীন চীনের দার্শনিকদের মধ্যে কনফুসিয়াস ছিলেন অন্যতম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত অমায়িক, ভদ্র ও দয়ালু ছিলেন। তার আচরণ ও গুণাবলি মানুষকে আকৃষ্ট করতাে। তিনি একজন আদর্শ শিক্ষকের ন্যায় তার শিষ্যদের সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ শিক্ষা দিতেন। কিন্তু তার এ আদর্শবাদ চীনের শাসকগােষ্ঠীকে সম্মত করতে পারেনি। ফলে তিনি নিরাশ হয়ে নিজ প্রদেশে ফিরে যান এবং সেখানে ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

কনফুসিয়াসের মতবাদঃ রাজনীতি, সমাজজীবন, শিক্ষা ও ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে কনফুসিয়াস গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ প্রদান করেন। নিম্নে তার মতবাদগুলাে বর্ণনা করা হলাে-

(১) রাজনৈতিক মতবাদঃ চীনের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে কনফুসিয়াস গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ প্রদান করেন। শাসকদের প্রতি তার উপদেশ ছিল, প্রজাদের জন্য যা লাভজনক তা খুঁজে বের কর এবং তাই তাদেরকে দাও। তার মতে, রাষ্ট্র একটি প্রকৃতিগত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এতে মানুষের দ্বারা পরিবর্তন সম্ভব। রাষ্ট্র মানুষের জন্য, মানুষ রাষ্ট্রের জন্য নয়। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবক্তা ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার ন্যায়সঙ্গত বন্টনের ওপর জোর দেন। তিনি যে রাষ্ট্রের চিন্তা করেন, সেখানে শাসক প্রজাদের কল্যাণের জন্য পদক্ষেপ নিবেন।

(২) জ্ঞান সম্পর্কে মতবাদঃ কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন, জ্ঞানই হলাে সকল সুখ ও সফলতার চাবিকাঠি। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন, যে, অদম্য ইচ্ছাশক্তি দ্বারা প্রায় সকলেই জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ছাত্রদের প্রতি তার উপদেশ ছিল যে, শিক্ষক যদি এক বিষয়ের একাংশ বুঝিয়ে দেন, তাহলে বাকি তৃতীয়াংশ ছাত্রদেরকে নিজ দায়িত্বে বুঝতে হবে। জ্ঞান ছাড়া কুসংস্কার মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। কনফুসিয়াস বলেন, “একটি প্রদীপের আলােকে যেমন সারা পৃথিবীর অন্ধকার গ্রাস করতে পারে না, ড্রপ জ্ঞানীকে কুসংস্কার, দুর্নীতি ও অন্যায় গ্রাস করতে পারে না।”

(৩) সামাজিক মতবাদঃ কনফুসিয়াস সৎ জীবন ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার প্রবক্তা ছিলেন। তিনি সমকালীন সমাজের বিভিন্ন অনাচার ও দুর্নীতি থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য সংস্কারের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের বৃহত্তর অঙ্গন পর্যন্ত পরস্পরের প্রতি দরদ, সহানুভূতি ও সহযােগিতা দেখানাের জন্য তিনি বলেন। তিনি সমাজে মানুষের মধ্যে পাঁচ ধরনের সম্পর্কের উপর গুরুত্ব দেন। যেমনঃ (১) রাজা-প্রজা, (২)পিতা-পুত্র, (৩) বড় ভাই-ছােট ভাই, (৪) স্বামী-স্ত্রী ও (৫) বন্ধু-বান্ধব।

(৪) শিক্ষা সম্পর্কিত মতবাদঃ কনফুসিয়াস সুশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন। সমাজের মঙ্গলের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় সহানুভূতি ও সরলতার প্রয়ােজন অনুভব করেন। তিনি ধারণা করেন যে, সুশিক্ষার দরুন সমাজে মহৎ ব্যক্তির সষ্টি হবে। কনফুসিয়াসের মতে, মহৎ ব্যক্তির ৯টি গুণ অর্জন করা আবশ্যক। যেমনঃ (১) চোখে যা দেখবে তা স্বচ্ছ দেখবে, (২) কানে যা শুনবে তা স্পষ্ট শুনবে, (৩) যা প্রকাশ করবে তা পরিষ্কার বলবে, (৪) অন্যদের প্রতি সম্মানজনক ব্যবহার করবে, (৫) কথা-বার্তায়। সরল হবে, (৬) ব্যবসায় উদ্যোগী থাকবে, (৭) সন্দেহজনক বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইবে, (৮) রাগের সময় এর ফলাফল ধারণা করবে, (৯) লাভের সময় সততার দিকে খেয়াল রাখবে।

(৫) পরিবার সম্পর্কে মতবাদঃ কনফুসিয়াসের মতে, পরিবার হলাে সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি। রাষ্ট্র হলাে সমাজের অঙ্গ আর পরিবার হলাে রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল। কনফুসিয়াস এ ব্যাপারে পিতৃপ্রধান পরিবারের প্রবক্তা ছিলেন। দিনে বহ্মাণ্ডের যেমন স্বর্গ হলাে কেন্দ্রবিন্দু, সেরূপভাবে পিতা হলাে পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। আর রাষ্ট্র শাসকের অবস্থার মনে হওয়া উচিত, তার মতে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে স্বর্গ ও মর্ত্য যেমনঃ সমাজজীবনে স্বামী-স্ত্রী একই পর্যায়ভুক্ত।

(৬) ধর্ম সম্পর্কে মতবাদঃ কনফুসিয়াস পূর্ব প্রচলিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন কিন্তু ধর্মীয় এবং অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপারে বেশি চিন্তা করেননি। তার কথা হলাে, আমরা এ জীবনকেই জানতে পারছিনা মত্যকে কী করে বুঝব? জীবিতদের প্রতি আমাদের কর্তব্য কী জানি না, মৃত্যুর প্রতি কর্তব্য কী করে জানব?

(৭) কনফুসিয়াসের মতবাদের প্রভাবঃ কনফুসিয়াসের মতবাদ চীনের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার লেখা গ্রন্থ সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। তার রক্ষণশীল মনােভাব এবং অতীতের প্রতি শ্রদ্ধাবােধ চীনাদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। কনফুসিয়াসের মতাদর্শ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসক তাদের স্বার্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রচার করে জনগণকে তাদের প্রতি অনুগত রাখার চেষ্টা করেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন চীনের দার্শনিকদের মধ্যে কনফুসিয়াস বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তার দর্শন তৎকালীন চীনের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। প্রথম দিকে তিনি ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতা। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি চীনের রাজনৈতিক নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। আর তার মতবাদ পরবর্তীকালের অনেক শাসক গ্রহণ করে জনগণকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক