স্পার্টার সামরিকবাদ সম্পর্কে আলােচনা কর


প্রশ্নঃ স্পার্টার সামরিকবাদ সম্পর্কে আলােচনা কর।
অথবা, স্পার্টার সামরিকবাদ সম্পর্কে যা জান লিখ।

ভূমিকাঃ প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রের একটি অন্যতম চরিত্র ছিল স্পার্টার। তারা ছিল অভিজাততান্ত্রিক। তবে কখনাে কখনাে তারা স্বৈরতান্ত্রিক মনােভাবের পরিচয় দিত। স্পার্টার প্রধান অবদান ছিল সামরিকবাদে। তারা রণনৈপুণ্যে বেশ শক্তিশালী ছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল তাদের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্পকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে স্পার্টারদের কোনাে আগ্রহ ছিল না। মূলত তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল সামরিক শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

স্পার্টার পরিচয়ঃ গ্রিসের লােকোনিয়া জেলার অন্যতম শহর ছিল স্পার্টা। এ সময় অন্যান্য নগর রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারা থেকে স্পার্টানরা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা ছিল ডরিয়ান বংশােদ্ভূত এবং গণতান্ত্রিক শাসনের বিরােধী। এ সময়ে তারা সংস্কৃতির দিক থেকে যােগাযােগবিহীন বা আবদ্ধ অবস্থায় ছিল। কারণ স্পার্টা উত্তর-পূর্বে এবং পশ্চিমে পর্বত দ্বারা বেষ্টিত ছিল।

স্পার্টানদের সামরিকবাদঃ খ্রিস্টপূর্ব আটশত অব্দে যখন তারা সমগ্র লোকোনিয়ার দখল করে নিতে সক্ষম হয়, তখন সামরিক শক্তি প্রয়ােগের অভ্যাস এমনভাবে শক্ত হয়ে শিকড় গেড়ে বসল যে তা আর সরিয়ে দেয়া গেল না। ফলে তখন অন্যান্য গ্রিক রাজ্যগুলাের আগ্রাসন নীতি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুঁকে পড়ে- খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ অব্দের শেষদিকে স্পার্টানরা স্থির করে যে, টেগেসাস পর্বতের পশ্চিমে অবস্থিত উর্বর সমতল ভূমি ‘মেছেনিয়া’ অধিকার করা একান্ত প্রয়ােজন। এর পঞ্চাশ বছর পর মেছেনিয়া আরগাছ-এর সঙ্গে যােগ দিয়ে বিদ্রোহ ঘােষণা করে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে স্পার্টানদের সাথে যুদ্ধ করে লোকোনিয়া পর্যন্ত দখল করে।

সরকার ব্যবস্থাঃ প্রাচীন আইন বিশারদ লুকারগাছ স্পার্টানদের জন্য যে সংবিধান তৈরি করেন সে সংবিধানে সরকার পদ্ধতি পুরাতন হেলেনিক সরকার গঠন প্রকৃতির রীতি অনুসরণ করা হয়। নিম্নে এগুলাে আলােচনা করা হলােঃ

(১) দুই রাজাঃ স্পার্টার রাজক্ষমতার প্রচলিত একজন রাজার পরিবর্তে দু’জন রাজা ছিলেন। যে কয়টি জায়গায় রাজতন্ত্র টিকে থাকে তাদের মধ্যে স্পার্টা প্রধান। কিন্তু দুই পরিবার থেকে দু'জন রাজা ছিল বলে স্বভাবতই রাজার ক্ষমতা অপ্রতিহত রইল না।

(২) Popular Assembly: স্পার্টার স্বাধীন নাগরিকেরা ত্রিশ বছর বয়স হলেই সভা বা সমিতির সদস্য হিসেবে পরিগণিত হবে। ৩০ বছর বয়স হলেই সে পূর্ণ নাগরিক এবং তখন Assembly-এর সদস্য হতাে। প্রতিমাসেই সভার অধিবেশন হতাে। সদস্যদের বিতর্ক বক্তৃতার অধিকার না থাকলেও রাজা বা এফরদের উপস্থাপিত প্রস্তাব Assembly গ্রহণ বা বর্জন করতে পারতাে।

(৩) Council of Eiders: দুজন রাজা এবং ২৮ জন সমাজপতি নিয়ে এই Council of Elders গঠিত হয়। এই ২৮ জনকে নির্বাচন করা হতাে Popular Assembly দ্বারা। কাউন্সিলের সদস্য হতে হলে অভিজাত বংশীয় এবং বয়স ষাট ঊর্ধ্ব হতে হবে।

(৪) এফর (Ephor): পপুলার এসেম্বলি ৫ জন এফর নির্বাচন করতাে। এই এফরেরা জনতার মুখপাত্র ছিল। শাসন ব্যাপারে তারা তত্ত্বাবধায়ক ছিল। রাজাকে ডেকে জবাবদিহি চাওয়ার অধিকার তাদের ছিল । দেওয়ানি মামলায় তারাই প্রধান বিচারক ছিল। এ ছাড়া স্পার্টার শাসন ও শৃঙ্খলা কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব তাদের ছিল। উপযুক্ত প্রশাসনিক কাঠামাে পর্যালােচনা করে রাজাদের মর্যাদা ও যুদ্ধকালে তাদের ক্ষমতা দেখে মনে হয় স্পার্টায় রাজতন্ত্র বিদ্যমান।

(৫) নাগরিকদের শ্রেণিবিন্যাসঃ এ সময় স্পার্টার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লক্ষ। এদের মধ্যে ৩টি শ্রেণি ছিল। যেমনঃ (১) স্পার্টার শাসকবর্গ। তারা স্পার্টার বিজয়ী যােদ্ধা বংশােদ্ভূত ছিল। যদিও তাদের সংখ্যা মােট জনসংখ্যার ১/২০ অংশ ছিল। (২) মর্যাদার দিক দিয়ে শাসক শ্রেণির পরেই পেরােসিদের স্থান ছিল। তারা স্পার্টারদের পাশাপাশি বাস করত। এ শ্রেণির আসল বংশ পরিচয় তেমন পাওয়া যায় না। (৩) সমাজের সর্বনিম্নে ছিল ভূমিদাস কষক। শাসক শ্রেণির শােষণের ফলে তারা নির্যাতিত এবং নিঃসম্বল হয়ে পড়ে।

(৬) কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতাঃ যারা স্পার্টার নাগরিক হিসাবে জন্মগত তাদের জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হতাে সম্মানিত ক্রীতদাসরূপে, বাধ্যতামূলকভাবে তাদেরকে কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার মর্যাদা ত্যাগ করতে হতাে। তাদের শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে সামরিক বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ বছর বয়স থেকে তাদেরকে দেশের জন্য কাজ করতে হতাে। যদিও বিবাহ বাধ্যতামূলক ছিল।

(৭) অর্থনৈতিক ব্যবস্থাঃ ভূমিদাস কৃষকরাই রাজ্যের আর্থিক সাহায্যের একমাত্র উৎস ছিল। তবে কৃষকদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প কাজে তারা অংশগ্রহণ করতে পারতাে না। আধুনিক ঐতিহাসিকরা অনেক সময় স্পার্টার অর্থনৈতিক পন্থা বা রীতিকে সাম্রাজ্যবাদী বলে অভিহিত করেন। তারা উৎপাদনের হাতিয়ার হিসাবে জমি ও কৃষকদের কাজে লাগাত। তবে কৃষকরা যে ফসল ফলাত তার অধিকাংশই মুনিবকে দিতে হতাে। ফলে স্পার্টানদের অর্থনৈতিক জীবন তেমন সচ্ছল ছিল না।

পরিশেষঃ আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, গ্রিকদের ইতিহাসে স্পার্টারগণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তারা সামরিক শক্তিতে বেশি শক্তিশালী ছিল। তাদের সামরিক কৌশল ছিল বেশ উন্নত। কেননা তাদের মেধা, জ্ঞান ও মনন সকল কিছু তারা সামরিক খাতে ব্যয় করতাে। স্পার্টারদের অর্থনৈতিক, সামরিক শাসন, গােপন পুলিশ, শাসনব্যবস্থা সামান্য কিছু লােকের হাতে ন্যস্ত ছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক