হযরত ওসমান (রা)-এর সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস বর্ননা কর


প্রশ্নঃ হযরত ওসমান (রা)-এর সময়ে আরব সাম্রাজ্য বিস্তৃতির ইতিহাস সংক্ষেপে আলােচনা কর।
অথবা, ওসমান (রা)-এর খেলাফতকালে বিদ্রোহ দমন ও বিজয়াভিযানসমূহ আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ খােলাফায়ে রাশেদার তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা)-এর শাসনকাল ছিল ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার শাসনামলের প্রথম ৬ বছরে তিনি সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানাও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। তবে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, তার খেলাফতকালের পরবর্তী বছরগুলাে ছিল বিপর্যয়পূর্ণ। তথাপি তার রাজ্য বিজয়ের ঘটনা ইতিহাসের পাতায় তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।

বিদ্রাহ দমন ও বিজয়াভিযানে ওসমান (রা): ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা) খেলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে কিছু প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। তিনি কঠোর হস্তে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং মুসলিম রাষ্ট্র সম্প্রসারণে আত্মনিয়ােগ করেন।

ক. বিদ্রোহ দমন
১. পারস্যের বিদ্রোহ দমনঃ
ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, হযরত ওসমান (রা) খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে পারস্য সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদেজর্দ হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বিদ্রোহ আরম্ভ করে। খলিফার আদেশে বসরার শাসনকর্তা অগ্রসর হয়ে নিশাপুর, মার্ভ, বলখ, তাবারিস্তান প্রভৃতি দখল করে পারস্যরাজের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দেন।

২. হামাদানের বিদ্রোহ দমনঃ খলিফা ওসমান (রা)-এর খেলাফতকালের প্রথম দিকে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ মােতাবেক ২৪ হিজরী সালে পারস্যের অন্তর্গত হামাদানের অধিবাসীরা বিদ্রোহ ঘােষণা করলে খলিফা তার বিশ্বস্ত অনুচর হযরত মুগীরা (রা)-এর অধিনায়কত্বে হামাদান পুনরুদ্ধার করেন।

৩. বাের দখলঃ একই বছর রাের অধিবাসীরা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইন্দ্রজাল বুনতে থাকলে খলিফার নির্দেশে হযরত আবু মুসা আশআরী ও বারা ইবনে আমের (রা) একদল সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ দমন করে পুনরায় তা দখল করেন। ফলে, বিদ্রোহীরা আর কখনাে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি।

৪. মিসরে রােমান আক্রমণ প্রতিহতঃ মিসরে মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও হযরত ওমর (রা)-এর মৃত্যুতে মিসর পুনরুদ্ধারের জন্য রােমান সম্রাট ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে এক বাহিনী প্রেরণ করে আলেকজান্দ্রিয়া দখল করেন। পরবর্তীতে মিসরের গভর্নর আমর ইবনুল আস (রা) অগ্রসরমান রােমান বাহিনীকে পরাস্ত করে আলেকজান্দ্রিয়া পুনর্দখল করেন।

৫. আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার বিদ্রোহ দমনঃ ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন, হযরত ওসমান (রা)-এর খেলাফতের তৃতীয় বর্ষে ৬৪৬ সালে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। ওয়ালিদ ইবনে ওকবার ত্বরিত পদক্ষেপে সেখানে ইসলামী খেলাফতের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু তাই নয়, একই সাথে আজারবাইজানের পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহও মুসলমানদের দখলে আসে।

৬. সিরিয়ায় রােমান আক্রমণ প্রতিহতঃ ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে এশিয়া মাইনর থেকে রােমানগণ এক বিরাট বাহিনীসহ সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া (রা) খলিফা কর্তৃক প্রেরিত আট হাজার সৈন্য এবং সিরিয়ার নিয়মিত বাহিনীর সাহায্যে রােমানদের আক্রমণ প্রতিহত করেন।

খ. বিজয় অভিযান
১. লিবিয়া জয়ঃ
২৫ হিজরী মােতাবেক ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবী সারাহ (রা) লিবিয়া আক্রমণ করে তা মুসলমানদের করায়ত্তে আনেন।

২. আলজেরিয়া ও মরক্কো বিজয়ঃ ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে এ যুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে যােবায়েরের নেতৃত্বে আল্লাহর অপরিসীম কদুরতের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আলজেরিয়া ও মরক্কো মুসলমানদের দখলে আসে। এভাবে ক্রমান্বয়ে সমগ্র উত্তর আফ্রিকা মুসলিম শাসনাধীনে আসে।

৩. পূর্ব আফ্রিকা জয়ঃ ২৬ হিজরী মােতাবেক ৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে আবদুল্লাহ ইবনে যােবায়ের (রা) পূর্ব আফ্রিকায় ইসলামী পতাকা উড্ডীন করেন।

৪. পূর্বাঞ্চলে নতুন এলাকা বিজয়ঃ হযরত ওসমানের শাসনকালে ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে সাঈদ ইবনুল আসের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী জুরজান, খােরাসান, কিরামান জয় করেন।.

৫. মধ্য এশিয়া বিজয় অভিযানঃ ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে আবদুল্লাহ ইবনে মের হিরাত, কাবুল, গজনী, সিজিস্তান, আকরান, খাওয়ারিজম এবং পার্শ্ববর্তী পার্বত্য এলাকা জয় করেন।

৬. পারস্যের অন্যান্য অঞ্চল বিজয়ঃ ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে মাভ মুসলমানদের দখলে আসে। তারপর বলখ, তুর্কিস্তান, হেরাত ও গজনীতে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়। এ সময় পারস্য সম্রাট করুণভাবে নিহত হয়।

৭. সােওয়াত, কাবুল, সিজিস্তান ও নিশাপুর বিজয়ঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) সােওয়াত, কাবুল, সিজিস্তান, নিশাপুর এবং এর পার্শ্ববর্তী অনেক অঞ্চল জয় করেন।

৮. মা-ওয়ারাউন নাহার, তাবারিস্তান ও কিরমান দখলঃ ৩০ হিজরী মােতাবেক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) ও হযরত সাঈদ ইবনুল আস (রা) সম্মিলিতভাবে মা-ওয়ারাউন নাহার আক্রমণ করেন। পরবর্তীতে তাবারিস্তান ও কিরমান মুসলিম অধিকারে আসে।

৯. আলেকজান্দ্রিয়ায় রােমান আক্রমণ প্রতিরােধঃ ৩১ হিজরা মােতাবেক ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে রােম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র কস্টান্টিন বিশাল নৌবহরের মাধ্যমে আলেকজান্দ্রিয়ায় হামলা চালায়। মুসলিম নৌবহরের সাথে উক্ত নৌবহরের মােকাবেলা হলে উভয় বাহিনীর মধ্যে প্রচও যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলিম নৌবাহিনী এ যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে রােমান বাহিনীকে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়।

১০. কনস্টান্টিনােপল বিজয়ঃ ৩২ হিজরী মােতাবেক ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুয়াবিয়া (রা) ইসলামী খেলাফতের সীমা কনস্টান্টিনােপল পর্যন্ত সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১১. সিসিল ও রােডস দ্বীপ দখলঃ ঐতিহাসিক মুইর বলেন, মুসলমানদের নবগঠিত নৌবাহিনী পরবর্তীকালে সিসিল ও রােডস দ্বীপ দখল করে সেখানে ইসলামের সােনালি পতাকা উড্ডীন করেন।

১২. সাইপ্রাস বিজয়ঃ ৩৩ হিজরী মােতাবেক ৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে সাইপ্রাসে বিদ্রোহ দেখা দিলে মুসলমানরা তা পুনরায় দখল করেন। এ সময়ে তারা আনাতুলিয়া এবং রােম সাগরের বহু দ্বীপও জয় করেন। দ্বিতীয় দফায় সাইপ্রাস অভিযানের সময় রােমান নৌবাহিনীর সাথে মুসলমানদের ৫০টিরও অধিক যুদ্ধ হয়। এ সকল যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হন।

১৩, হিসনুর রুয়াত বিজয়ঃ হজরত ওসমান (রা)-এর শাসনামলের শেষের দিকে ৩৩ হিজরী মােতাবেক ৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (রা) রােম ভূখণ্ডের হিসনুর রুয়াত’ নামক স্থান দখল করেন।

১৪. ত্রিশােলী দখলঃ আবদুল্লাহ ইবনে সাদ (রা) মিসরের দায়িত্ব গ্রহণ করার সাথে সাথে রােমান শাসনকর্তা গ্রেগরী আবার মিসরে হানা দিতে শুরু করে। ফলে আবদুল্লাহ ইবনে সাদ (রা) তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে রােমানদের সাথে মুসলমানদের এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে রোমানগণ পরাজিত এবং তাদের শাসনকর্তা গ্রেগরী নিহত হয়। ফলে ৩৪ হিজরী মােতাবেক ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপােলী মুসলমানদের করতলগত হয়।

উপসংহারঃ হযরত ওসমান (রা) আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা স্থাপন করে স্বীয় প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা বিজয়াভিযান অব্যাহত রাখেন। তাই বিজেতা হিসেবে তিনি নিঃসন্দেহে কৃতিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক