হেলেনীয় যুগে কলা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গ্রিকদের অবদান বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ হেলেনীয় যুগে কলা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গ্রিক প্রতিভার অবদান সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখ।
অথবা, হেলেনীয় যুগের কলা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আলােচনা কর।
অথবা, হেলেনীয় যুগে কলা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গ্রিকদের অবদান বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ হেলেনীয় বলতে মেসিডােনিয়া বিজয়ের পূর্ববর্তী গ্রিক সভ্যতাকে বুঝায়। হােমারীয় যুগের (১২০০ খ্রিঃপূর্ব) ভিত্তিভূমির ওপর যে গ্রিসের সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল তার নাম দেয়া হয়েছে হেলেনিক সভ্যতা। এ সভ্যতার ব্যাপ্তিকাল হােমারীয় যুগ থেকে আলেকজান্ডারের উদয়ের কাল পর্যন্ত। মূল গ্রিক ভূ-খণ্ড ছাড়াও আইওনিয়া, ক্রিট, সাইপ্রাস ইত্যাদি গ্রিক উপনিবেশে এসভ্যতার বিকাশ ঘটে। গ্রিক নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এথেন্সের প্রভাব এতই প্রবল ছিল যে, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এথেন্সের মূল্যায়ণই প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

সভ্যতায় হেলেনীয়দের অবদানঃ সভ্যতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে হেলেনীয় গ্রিক সভ্যতার অবদান ছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

(১) হেলেনীয় দর্শনঃ দর্শনের ক্ষেত্রে গ্রিকদের অবদান ছিল অপরিসীম। মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে গ্রিক দার্শনিকগণ বিশ্বকে একটি সমৃদ্ধ দর্শন উপহার দেন। পৃথিবী কিভাবে টিকে আছে এবং কিভাবেই বা এর পরিবর্তন ঘটছে, এসব বিষয় ছিল সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিক দর্শনের মূলক্ষেত্র। এ সময়ে গ্রিক দর্শনেনানা কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল। তবে দার্শনিক থেলিস সর্বপ্রথম (৫৮৫ খ্রিঃপূঃ) সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, মানুষের পাপের কারণে সূর্যগ্রহণ হয় বলে ধারণা প্রচলিত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক কারণেই সূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়ে থাকে।

(২) হেলেনীয় সাহিত্যঃ গ্রিক কবি হােমার খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে তার বিখ্যাত মহাকাব্য ইলিয়ড ও ওডেসি এর মাধ্যমে এশিয়া মাইনরের ট্রয় নগরী কিভাবে গ্রিক জাতিগােষ্ঠী দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল (খ্রিঃপূঃ ১২০০ অব্দে) সে কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। হােমার তার এ মহাকাব্যে বিভিন্ন দেবদেবীর বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ক্রমে হােমারের এ মহাকাব্যে গ্রিকদের নিকট ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।

(৩) হেলেনীয় ইতিহাসঃ ইতিহাসচর্চায় গ্রিকদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে হেরােডটাসের ও থুকিডাইডিস ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুই ঐতিহাসিক ও ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরােডােটাসকে বলা হয় ইতিহাসের জনক। Historia শব্দের অর্থ অনুসন্ধান। Historia শব্দেরই পরিবর্তিতরূপ হচ্ছে History। History বা ইতিহাসকে অনুসন্ধান অর্থে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন গ্রিক ঐতিহাসিক হেরােডটাস। তার বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থের নাম 'History of the Persian wars' সংক্ষেপে History। পারস্যের বিরুদ্ধে গ্রিকদের যুদ্ধ সম্পর্কে তিনি যা দেখেছেন, শুনেছেন ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন তার একটি মনােজ্ঞ বিবরণ তুলে ধরেছেন History of The Persian Wars নামক তার ইতিহাস গ্রন্থে। এ গ্রন্থটি পৃথিবীর প্রথম ইতিহাসগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। এ গ্রন্থটি ৯টি উপখণ্ডে বিভক্ত।

(8) হেলেনীয় বিজ্ঞানঃ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হেলেনীয় সভ্যতার অবদান ছিল অপরিসীম। গ্রিক বিজ্ঞানী থেলিস সূর্যগ্রহণের সময় নিরূপণ করে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে প্রাকৃতিক নিয়মেই সূর্যগ্রহণ হয়ে থাকে। এতকাল তাদের ধারণা ছিল যে, মানুষের পাপের কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়ে থাকে। গ্রিক বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর মানচিত্র অংকন করে দেখিয়েছেন যে, পৃথিবী সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাছাড়া তারা এটাও ব্যাখ্যা করেছিলেন যে পৃথিবী একটি জ্যোতিষ্ক এবং তা নিজ গতিতেই আবর্তিত হয়। পৃথিবী যে বৃত্তাকার, গাণিতিকভাবে এটা তিনি প্রমাণ করেন।

(৫) হেলেনীয় লিখন পদ্ধতিঃ লিখন পদ্ধতির ক্ষেত্রে হেলেনীয় গ্রিকদের অবদান অপরিসীম। গ্রিকরা লিখন পদ্ধতি শিখেছিল ফিনিশীয়দের নিকট থেকে। ফিনিশীয়দের উদ্ভাবিত ২২টি বর্ণমালার সাথে গ্রিকরা আরও ৪টি বর্ণ (e i o u) যােগ করে মােট ২৬টি বর্ণের বর্ণমালা তৈরি করেছিল, যা আধুনিক ইংরেজি ভাষায় গৃহীত হয়েছে।

(৬) হেলেনীয় স্থাপত্যঃ গ্রিকরা ছিল কল্পনাবিলাসী ও শৈল্পিক চেতনাসমৃদ্ধ জাতি। গ্রিক স্থাপত্য ছিল নির্মাণ কৌশলের দিক থেকে নিখুঁত। এ ক্ষেত্রে গ্রিক স্থপতিরা মনে করতেন যে, সারল্য ও সঠিক পরিমাপের মধ্য দিয়েই সৌন্দর্য ফুটিয়ে তােলা সম্ভবপর। গ্রিক স্থাপত্যের কৌশল বিচার করতে গিয়ে থামের আকৃতি ও নির্মাণরীতি পর্যবেক্ষণ করে তিন শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।
(ক) ডােরীয় রীতিঃ এই রীতির থামগুলাে ছিল মােটা আকৃতির এবং কেন্দ্র ছিল চতুষ্কোণ;
(খ) আইওনীয় রীতিঃ এই রীতির থামগুলাে লম্বা ও সরু আকৃতির এবং কেন্দ্রভাগ ছিল কারুময় ও পেঁচানাে;
(গ) কারিন্থীয় রীতিঃ সরু ও লম্বা আকৃতির থাম এবং তার কেন্দ্রভাগ ছিল পাতার ডিজাইনে কারুকার্যে সমৃদ্ধ। এগুলাের মধ্যে শক্তিমান ডােরীয় রীতিই গ্রিসে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বিখ্যাত গ্রিকমন্দির পার্থেনন, এথেন্সে দেবী এথেনার মন্দির ইত্যাদি এ ধরনের স্থাপত্যিক আদর্শেই তৈরি।

(৭) হেলেনীয় ভাস্কর্যঃ ভাস্কররা গ্রিক সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। শিল্পচর্চা, উচ্চাঙ্গ নাগরিকবােধের দালানকোঠা ও মন্দিরগুলাে অলঙ্কারসমৃদ্ধ করার পেছনে দু’টো উদ্দেশ্য কাজ করতাে। প্রথমটি নগরের সৌন্দর্যবর্ধন, দ্বিতীয়টি দেবতাদের মনতুষ্টি। গ্রিকরা তাদের দেবতাদের মানুষের মতােই দেহধারী মনে করতাে। তাই দেবমূর্তি তৈরি করতে গিয়ে মানুষের মূর্তি গড়ায় গ্রিক ভাস্করগণ অপূর্ব দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

(৮) হেলেনীয় সংগীতঃ শিল্পপ্রেমিক গ্রিক জাতি টায়রান্টদের যুগ থেকেই বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবনের কতিত্ব জড়িয়ে আছে। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে ধর্মসঙ্গীত গাওয়ার প্রয়ােজনে বাদ্যযন্ত্র ও সঙ্গীতের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছিল।

পরিশেষঃ আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, প্রাচীন গ্রিস বা হেলেনীয় সভ্যতার নিকট আধুনিক বিশ্ব বিভিন্নভাবে ঋণী। এথেন্স গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভাবন করে বিশ্বকে নতুন রাজনৈতিক দষ্টিভঙ্গি দান করে। এ শিক্ষা ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে থাকবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পাশাপাশি গ্রিক সভ্যতা বিশ্ববাসীকে দর্শন, বিজ্ঞান, ভাস্কর্য, লিখন পদ্ধতি ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নতুন ধারণা দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক