আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি আলােচনা কর


প্রশ্নঃ আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি আলােচনা কর।
অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি কী কী? আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্যের অন্ত নেই। সেই প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনাে মতৈক্য গড়ে ওঠেনি। বস্তুত রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য তার প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। আর রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রসঙ্গেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্তহীন বাদানুবাদ বর্তমান। স্বভাবতই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সম্পর্কে কোনাে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যঃ প্রাচীনকালে গ্রিসের প্লেটো এরিস্টটল প্রমুখ দার্শনিকগণ ‘সুন্দর মঙ্গল জীবনের প্রতিষ্ঠাকে’ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বলে মনে করতেন। জন লকের মতে, মানবসমাজে মঙ্গলসাধন করা আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য হলেও সম্পত্তির সংরক্ষণ করাই হলাে তার চরমতর উদ্দেশ্য। ফরাসি দার্শনিক রুশাের মতানুসারে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মঙ্গলময় জীবন সম্ভব করার জন্য।

অ্যাডাম স্মিথের মতেঃ অ্যাডাম স্মিথ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি রাষ্ট্রের তিনটি মুখ্য উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন, (ক) অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সমাজকে রক্ষা করা। (খ) সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে অন্যায়-অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা। (গ) ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অসম্ভব এমন সব কাজ কর্ম সম্পাদন করা এবং জনগণের প্রয়ােজনীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ গঠন ও সংরক্ষণ করা।

বেস্থামের মতেঃ হিতবাদী বেন্থাম উনবিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে বলেছেন, রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হলাে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক মঙ্গলসাধন। সমাজ সেবা, ন্যায়বিচার প্রভৃতিও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বলে অনেকে মনে করেন।

কান্ট, হেগেল প্রমুখের মতেঃ কান্ট, হেগেল প্রমুখ আদর্শবাদী দার্শনিকগণ রাষ্ট্রকেই মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে, ব্যক্তি হলাে রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যের মাধ্যম। এদের ধারণা অনুসারে রাষ্ট্রের সার্থকতা তার নিজের মধ্যেই নিহিত।

উইলােবির মতেঃ মার্কিন চিন্তাবিদ উইলােবি তিনভাগে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যকে বিভক্ত করেছেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও চরম। শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা সংরক্ষণ হলাে প্রাথমিক উদ্দেশ্য। ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপক বিস্তার হলাে মাধ্যমিক উদ্দেশ্য এবং অর্থনৈতিক, মানসিক ও নৈতিক কল্যাণসাধন হলাে চরম উদ্দেশ্য।

আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলিঃ প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে মােট দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ অপরিহার্য বা মৌলিক এবং গৌণ বা ঐচ্ছিক।

৩. মৌলিক কার্যাবলিঃ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে যে সকল কাজ অবশ্যই করতে হয় সেই সকল কাজকে রাষ্ট্রের প্রাথমিক বা অপরিহার্য কাজ বলে।

অপরিহার্য কার্যাবলি নিম্নরূপঃ
(১) প্রশাসন পরিচালনার কার্যঃ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রকে শাসন বিভাগ গঠন করতে হয়। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য উপযুক্ত লােক নিয়ােগ ও নীতিমালা রচনা করা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলাের অন্যতম।

(২) সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের কাজঃ বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের একটি মৌলিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্র সেনাবাহিনী গঠন ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে থাকে।

(৩) বিচার সংক্রান্ত কাজঃ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। এ জন্য রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ সংগঠন ও পরিচালনা করতে হয়।

(৪) শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করাঃ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রকে পুলিশ বাহিনী গঠন করতে হবে।

(৫) জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানঃ জনগণ যাতে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে রাষ্ট্রে বাস করতে পারে, সেজন্য তাদের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা আধুনিক রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য।

(৬) অর্থনৈতিক কাজঃ রাষ্ট্রের নানাবিধ কার্য সম্পাদনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন, তাই কর নির্ধারণ করা এবং সুষ্ঠুভাবে ব্যয় নির্বাহ করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য।

ঐচ্ছিক কার্যাবলিঃ আধুনিক কল্যাণকর রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য জনগণের সর্বাঙ্গিন কল্যাণসাধন ও উন্নততর জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করা। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র যেসকল কাজ সম্পাদন করে সেগুলােতে ঐচ্ছিক কাজ বলে। ঐচ্ছিক কার্যাবলি নিম্নরূপ-

(১) শিক্ষা সংক্রান্ত কাজঃ জনগণকে শিক্ষিত করে সচেতন করে তােলাই হলাে রাষ্ট্রের একটি দায়িত্ব। এজন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা পাঠাগার নির্মাণ এবং এগুলাের পরিচালনার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজের অন্তর্ভুক্ত।

(২) স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কাজঃ জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মাতৃসদন ইত্যাদি নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করে।

(৩) কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায় সংক্রান্ত কাজঃ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নসাধনের জন্য রাষ্ট্র, কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহুবিধ কাজ করে থাকে। এ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ব্যাংক স্থাপন করে নানা রকম সুযােগ-সুবিধা দেয়া হয়।

(৪) শ্রমিক কল্যাণঃ আধুনিক কল্যাণকর রাষ্ট্রসমূহ শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য বেতন, বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি প্রদান করে থাকে।

(৫) যোগাযোগ সঙ্ক্রান্ত কাজঃ যােগাযােগ ব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও উন্নতি অনেকাংশে নির্ভর করে। জন্য রাষ্ট্র সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ, নৌ, বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠা, ডাক যােগাযােগ স্থাপন করে ও ঐসব সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেশ ও কালভেদে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাষ্ট্রের কার্যাবলির পরিধি সম্পর্কিত ধারণারও পরিবর্তন হয়। তাই রাষ্ট্রের কর্মপরিধির কোনাে সীমারেখা টানা সম্ভবপর নয়। তবে আধুনিক রাষ্ট্র প্রধান পুলিশি রাষ্ট্রের ধারণা পরিত্যাগ করে সমাজ কল্যাণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক