হুনাইন যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর


প্রশ্নঃ হুনাইনের যুদ্ধ কখন কিভাবে সংঘ। এ যুদ্ধের ফলাফল নির্ণয় কর।
অথবা, হুনাইন যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

উপস্থাপনাঃ মক্কা বিজয়ের পর অবশিষ্ট সমগ্ৰ কুফরি শক্তি আরাে একবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের পতনের প্রচেষ্টা চালায়। তায়েফের হাওয়াযিন ও সাকিফ গােত্র এতে নেতৃত্ব দেয়। তাদের বিশ হাজার সৈন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে রণপ্রস্তুতি নেয়। অষ্টম হিজরীর শেষ ভাগে হুনাইন প্রান্তরে তাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে এটাই হুনাইনের যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত।

হুনাইন যুদ্ধের কারণঃ
১. কাবা পুনঃদখলের চেষ্টাঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে কাবাঘর মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। কাবাঘরে সংরক্ষিত প্রতিমাগুলাে চূর্ণ বিচূর্ণ করা হয়। এ ঘটনা পৌত্তলিকদের কাছে অসহ্য ছিল। তাই তারা গােপনে গােপনে কাবাঘর পুনর্দখলের চেষ্টা করছিল।

২. মক্কার নও মুসলিমদের সাথে বিরূপ আচরণঃ মক্কার কাফেররা নও মুসলিমদের সাথে সর্বদা বিরূপ আচরণ করত। যা অনেক ক্ষেত্রেই সহ্য করার মতাে ছিল না।

৩. আর্থিক উন্নয়নের স্বপ্নঃ পৌত্তলিক গােষ্ঠী ভেবেছিল, মক্কা নগরী হতে মুসলিম শক্তিকে নির্মূল করতে পারলে তারা সহজেই মক্কায় বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হবে। ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন, বেদুইন পৌত্তলিকরা মুসলমানদের বিনাশ সাধনের মাধ্যমে বাণিজ্য সুবিধাসহ যাবতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে একচেটিয়া প্রাধান্য বজায় রাখার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল।

৪. পৌত্তলিকতাপ্রীতিঃ মক্কা বিজয়ের পরও বনু সাকিফ, বনু হাওয়াযিন, বনু জুযাম, বনু নাসর ও বনু সাদ গােত্রসহ বেশ কিছু গােত্র মন থেকে প্রতিমা পূজার মায়া ত্যাগ করতে পারছি না। বিশেষ করে বনু সাকিফ ও বনু হাওয়াযিন গােত্রদ্বয় তাদের পৌত্তলিকতা ও নিজেদের সমান রক্ষার জন্য মালেক ইবনে আওফের নেতৃত্বে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে।

৫. আত্মসমর্পণের আশঙ্কাঃ সমগ্র আরব দেশে মুসলমানদের সার্বিক উন্নতি দেখে বেদুইন গােত্রগুলাে বুঝতে পেরেছিল, তাদের মুসলমানদের কাছে হয়ত আত্মসর্মপণ করতে হবে। এরূপ আশঙ্কা বােধ করে তারা মুসলমানদের ক্ষতিগত করার জন্য যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহঃ
১. কাফেরদের রণপ্রস্তুতিঃ বনু সাকিফ ও হাওয়াযিন গােত্রের প্ররোচনায় বনু কাব ও বনু কিলাব ব্যতীত অন্যান্য সকল গােত্র থেকে ২০,০০০ সৈন্য মক্কা ও তায়েফের নিকট ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ মােতাবেক অষ্টম হিজরীতে একত্রিত হয়। মধ্যবর্তী পাহাড় হুনাইনের নিকট ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ মােতাবেক অষ্টম হিজরীতে একত্রিত হয়।

২. মহানবী (স)-এর যুদ্ধযাত্রাঃ মহানবী (স) কাফেরদের রণপ্রস্তুতির সংবাদ পেয়ে অতি অল্প সময়ে মক্কা বিজয়ে উপস্থিত ১০,০০০ মুসলমান ও ২,০০০ নও মুসলিমসহ মােট ১২,০০০ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেন।

৩. মহানবী (স)-এর নেতৃত্বে যুদ্ধঃ ঐতিহাসিক মাসুদী বলেন, এ যুদ্ধে মহানবী (স) নিজেই নেতৃত্ব দেন।

৪. প্রাথমিক বিপর্যয়ঃ যুদ্ধের ময়দানে সংখ্যাধিক্য ও বৈষয়িক উপকরণ পর্যাপ্ততায় মুসলমানগণ নিজেদের নিশ্চিত বিজয়ী মনে করে উল্লসিত হয়ে পড়ে। এ সুযােগে শত্রু বাহিনী তীব্র আক্রমণ করলে মুসলিম বাহিনী সাময়িক বিপর্যয়ে পড়ে।

৫. মুসলমানদের প্রচণ্ড আক্রমণঃ প্রাথমিক ভুল বুঝতে পেরে পুনরায় মুসলিম বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়, এতে যুদ্ধের মােড় ঘুরে যায় এবং শত্রুরা শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

হুনাইন যুদ্ধের ফলাফল/তাৎপর্য/ গুরুত্বঃ
১. কাফেরদের শােচনীয় পরাজয়ঃ ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, হুনাইন যুদ্ধে কাফের বাহিনীর শােচনীয় পরাজয় ঘটে। এ যুদ্ধে কাফেরদের ৭০ জন নিহত আর ৬০০ জন বন্দি হয়, অপরদিকে মুসলমানদের ৪/৫ জন শাহাদাত বরণ করেন।

২. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনঃ এ যুদ্ধে কাফেরদের অজস্র অস্ত্রশস্ত্রসহ ২৪,০০০ মেষ, ২৮,০০০ উট এবং ৪১,০০০ তােলা স্বর্ণ-রৌপ্য মুসলমানদের হাতে চলে যায়।

৩. কুফরী শক্তির চূড়ান্ত পরাজয়ঃ মক্কা বিজয়ের পর সমগ্র আরব ভূখণ্ডে কাফেরদের যতটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল, হুনাইন যুদ্ধের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতাে সাহস আর তাদের অবশিষ্ট থাকল না।

৪. অহংকারের পতনঃ কাফেরদের শেষ অহংকারটুকুও এ যুদ্ধে বিলীন হয়ে যায়। কারণ ২০ হাজার কাফের সৈন্য তাদের সংখ্যার মাত্র অর্ধেক মুসলমানের কাছে। এবারও পরাজিত হয়। ঐতিহাসিক খােদা বক্স বলেন, এ যুদ্ধের মাধ্যমে কাফেরদের শেষ অহঙ্কারটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল।

৫. আল্লাহর সাহায্য লাভঃ হুনাইন যুদ্ধের কঠিন মুহুর্তে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের সাহায্য করেছেন। সূরা তাওবার ২৫, ২৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

৬. মুসলমানদের শিক্ষা লাভঃ হুনাইন যুদ্ধে মুসলমানগণ শিক্ষা লাভ করলেন যে, সংখ্যাধিক্য, বস্তুগত উপায় উপকরণ ও বৈষয়িক শক্তি সামথ্যই বিজয়ের হাতিয়ার নয়; বরং এক্ষেত্রে প্রয়ােজন সর্বোপরি আল্লাহর ওপর ভরসা ও তার সাহায্য।

৭. সামরিক গুরুত্বঃ এ যুদ্ধে মহানবী (স) সেনাবাহিনীকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে দলীয় প্রধানদের নিকট তাদের পতাকা হস্তান্তর করেন। তিনি নিজেও যুদ্ধের পােশাক পরিহিত অবস্থায় খচ্চরের ওপর আরােহণ করে মুসলিম সেনাদের নির্দেশ প্রদান করেন।

৮. মহানবী (স)-এর প্রতি আনুগত্যঃ এ যুদ্ধে হাওয়াযিন ও সাকিফ গােত্র পরাজয় বরণ করার পর আরবের অন্য কোনাে গােত্র পুনরায় রাসূল (স)-এর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার পরিবর্তে তার বশ্যতা ও আনুগত্য স্বীকারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

উপসংহারঃ হুনাইন যুদ্ধের ফলে আরব ভূমি মুসলমানদের পূর্ণাঙ্গ দখলে আসে এবং আনসার ও মুহাজেরীনের সকল সংশয় বিদূরিত হয়। তাই ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এ যুদ্ধ ঐতিহাসিক ও সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। এক কথায় এ যুদ্ধ সর্বদিক থেকে সকল মুসলিম তথা বিশ্বের মানুষের জন্য এক শিক্ষণীয় বিষয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক